Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
Suicide Disease

‘সুইসাইড ডিজ়িজ়’, চিকিৎসায় ফিরল মুখের হাসি

তীব্র যন্ত্রণা ও হতাশার গ্রাস থেকে বাঁচতে অনেকেই শেষমেশ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তাই রোগের এমন নাম। চিকিৎসার পরিভাষায় এর পরিচয় অবশ্য ‘ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া’।

doctors

—প্রতীকী ছবি।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৪ ০৭:৫২
Share: Save:

মুখ থেকে মিলিয়ে গিয়েছিল হাসি। কথা বলতে গেলেও কষ্ট। মুখের পেশি সামান্য নড়লেই যেন মৃত্যুযন্ত্রণা। এমনকি রোজের ডাল-ভাত-তরকারিও মুখে তোলা দুঃসহ হয়ে উঠেছিল প্রৌঢ়ের। খেতে গেলেই বিদ্যুতের শকের মতো কিছু একটা খেলে যেত সারা শরীরে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠত মুখ। গোড়ায় দাঁতের ডাক্তার দেখিয়েছিলেন শ্রীরামপুরনিবাসী ৫৮ বছর বয়সি প্রৌঢ় রথীন দত্ত। তার পর আরও বহুবিধ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছিলেন। শেষে জানা যায়, এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। নাম ‘সুইসাইড ডিজ়িজ়’।

তীব্র যন্ত্রণা ও হতাশার গ্রাস থেকে বাঁচতে অনেকেই শেষমেশ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তাই রোগের এমন নাম। চিকিৎসার পরিভাষায় এর পরিচয় অবশ্য ‘ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া’। মুখের দু’পাশ দিয়ে গিয়েছে ট্রাইজেমিনাল নার্ভ বা স্নায়ু। এর গঠনগত অস্বাভাবিকত্বে (অ্যানাটমিকাল অ্যাবারেশন) এই অসুখ হয়। এক জটিল চিকিৎসা পদ্ধতিতে রথীনকে সুস্থ করেছেন কলকাতার একদল চিকিৎসক, যাঁর নেতৃত্বে ছিলেন রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট সায়ন পাল। দলটিতে ছিলেন নিউরো রেডিয়োলজিস্ট নির্মাল্য রায়, পেন স্পেশ্যালিস্ট দেবাঞ্জলি রায়, নিউরোলজিস্ট দেবব্রত চক্রবর্তী এবং মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট বিপ্লব সরকার।

সায়ন জানিয়েছেন, মুখের ট্রাইজেমিনাল স্নায়ুর উপর দিয়ে যদি কোনও ভাবে রক্তনালি চলে যায়, সে ক্ষেত্রে দুয়ের ঘর্ষণে শুরু হয় যন্ত্রণা। আচমকাই দেখা দিতে পারে প্রদাহ। এর নেপথ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে থাকে স্ট্রেস— মানসিক ক্লান্তি, শারীরিক চাপ। এ রোগের সেই অর্থে কোনও ওষুধ নেই। একমাত্র কার্যকর চিকিৎসা ‘স্টিরিয়োট্যাকটিক রেডিয়োসার্জারি’ (এসআরএস)। তা-ও দেশের খুব কম জায়গাতেই হয়। মাথা ও ঘাড়ের সংযোগস্থলে রয়েছে ট্রাইজেমিনাল নার্ভের উৎসস্থল। মস্তিষ্কের ভিতরে খুব ছোট্ট এই জায়গাটিকে উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন দিয়ে ব্লক করা হয়েছে। তাতেই কমেছে যন্ত্রণা। তবে প্রক্রিয়াটি একেবারেই সহজ নয়। মস্তিষ্কের ওই জায়গা দিয়ে অসংখ্য স্নায়ু চলে গিয়েছে। একটু এ-ধার ও-ধার হলেই বড় বিপদ হতে পারে। তাই প্রথমে কম্পিউটারে ‘যুদ্ধের’ ছক কষেছিলেন চিকিৎসকেরা। তার পরে ‘পুতুলের’ উপরে হাত পাকানো হয়। শেষে রোগীর মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে রেডিয়েশন দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কোনও কাটাছেঁড়া, অস্ত্রোপচারের বিষয় নেই। বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে মস্তিষ্কের ভিতরে নির্দিষ্ট জায়গাটিকে চিহ্নিত করা হয়। তার পর সেখানে রেডিয়েশন দেওয়া হয়। সায়ন বলেছেন, ‘‘এক জন ক্যানসার রোগীকে যে রেডিয়েশন দেওয়া হয়, তার পাঁচ গুণ তীব্রতার রেডিয়েশন দেওয়া হয় এ ক্ষেত্রে।’’ তাতেই মিলেছে সুখবর। শুধু রথীন দত্ত নন, একই অসুখে আক্রান্ত আর এক রোগী ত্রিপুরার বাসিন্দা রতন দেবনাথও এই চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ। সায়ন জানিয়েছেন, তাঁর দুই রোগীই ভাল আছেন। কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হয়নি। ৮-৯ মাস হয়ে গিয়েছে, দু’জনেই যন্ত্রণামুক্ত।

রথীন দত্তের ছেলে রৌনক জানান, ২০২০-’২১ সাল নাগাদ উপসর্গ দেখা দেয় তাঁর বাবার। গোড়ায় দাঁতে ব্যথা হত। তাই দাঁতের ডাক্তারের কাছেই গিয়েছিলেন। তার পর একে একে স্নায়ু বিশেষজ্ঞ, পেন ম্যানেজমেন্ট। দু’-তিন বছর মতো কার্যত বিনা চিকিৎসায় ছিলেন। রৌনক বলেন, ‘‘সকলেই বলছিলেন, এর কোনও চিকিৎসা নেই। স্নায়ুর রোগ শুনে স্নায়ু বিশেষজ্ঞের কাছে গেলাম, তাঁরাও বললেন কিছু করার নেই। হতাশ লাগত।’’ তিনি জানান, পুরোপুরি তরল খাবার খেয়ে থাকতে হত রথীনকে। খাবার চিবোতে গেলেই তীব্র যন্ত্রণা। একটা চোখ ছোট হয়ে গিয়েছিল। সেই কষ্ট এখন আর নেই। রৌনক বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু বলেছিলেন ৮০ শতাংশ সুস্থ হয়ে যাবে বাবা। কিন্তু সম্পূর্ণ কমে
গিয়েছে যন্ত্রণা।’’

সায়ন জানান, এসআরএস-এর দু’দিন পরে তাঁরা ভাত, ডাল, তরি-তরকারি, মাছ খেতে দিয়েছিলেন রোগীকে। প্রায় দু’বছর বাদে মন ভরে খেয়েছিলেন তিনি। সায়নের কথায়, ‘‘চিকিৎসক হিসেবে এই তৃপ্তি বলে বোঝাতে পারব না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Health Doctors
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy