রেস্তরাঁর বিল মেটাচ্ছেন কর্মীরাই! ফাইল চিত্র
রেস্তরাঁগুলি এখন টেবিলে সাজিয়ে-গুছিয়ে মেনুচার্ট রাখে। মধ্য কলকাতার চাঁদনি চকের ১২০ বছরের পুরনো একটি রেস্তরাঁ ইচ্ছে থাকলেও তা করতে পারছে না। তাদের টেবিলে শোভা পাচ্ছে একটি বড়সড় আবেদনমূলক বার্তা। সেখানে ছাপার অক্ষরে লেখা, ক্ষুধা নিবৃত্ত করার পর রেস্তরাঁ ছাড়ার আগে সকলে যেন দামটা মিটিয়ে যান! প্রায় পুরোটাই সাধুভাষায় লেখা ওই বার্তা বলছে, ‘মাননীয় মহাশয়, আপনাদের এতদ্বারা জানাইতেছি যে, আমাদের রেস্তরাঁয় মদ্য এবং খাদ্য যাঁরা গ্রহণ করিবেন, তাঁহাদের যদি ধূমপান করিবার ইচ্ছা হয়, তা হলে সবাই মিলে বাহিরে না গিয়ে কেউ একজন ভিতরে থাকিবেন। কেননা, অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাইতেছি যে, পরপর কয়েকদিন কেউ কেউ খরিদ্দার ধূমপান করিতে গিয়ে গেটের বাহিরে গিয়া আর ভিতরে আসেন নাই। ফলস্বরূপ ওই খরিদ্দারের পেমেন্ট ওয়েটারকে দিতে হয়েছে। আমরা কাস্টমারদের গরিব ভাই। আমাদের অবস্থার কথা বিবেচনা করিয়া আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করিলে চিরকৃতজ্ঞ থাকিব।’
খাওয়ার পর তার দাম দিতে হবে, এই অত্যন্ত স্বাভাবিক কথাটা টেবিলে টেবিলে ফলাও করে লিখতে হল কেন এই রেস্তরাঁ তথা পানশালাকে? কর্মীদের থেকে যা জানা গেল, অনেকেই খেয়ে-পিয়ে বিল না মিটিয়ে চলে যাচ্ছেন। এই সব বিত্তশালী বাবুদের সবাই যে শুধু নেশার ঘোরে টাকা মেটাতে ভুলে যাচ্ছেন, তা নয়। অধিকাংশই করছেন ইচ্ছাকৃত ভাবে। অন্তত কর্মীদের তেমনই দাবি।
খেয়ে টাকা না দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পিছনে ফিকিরটা কী? কর্মীরা বলছেন, যেহেতু রেস্তরাঁর ভিতরে ধূমপান করা যায় না, সেই সুযোগটাই নেয় ‘অপরাধীরা’। এমনকি, পাঁচ-ছ’জন বা ১০-১২ জনের বড় দল এলেও তাদের পক্ষে খেয়েদেয়ে পালিয়ে যাওয়াটা বিশেষ কঠিন হচ্ছে না। সিগারেট খাওয়ার নাম করে প্রথমে দু’জন বাইরে যাচ্ছেন। তার পর আরও দু’-তিন জন। শেষে বাকিরা। নেশার শেষ টানটা দিতে দিতে অবলীলায় তাঁরা কেউ গাড়িতে, কেউ ট্যাক্সিতে চেপে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রেস্তরাঁর উল্টোদিকের ফুটপাথেই মেট্রো স্টেশন। সেটাও পলায়নে বাড়তি সুযোগ এবং সুবিধা করে দিচ্ছে।
গোটা ব্যাপারটা যখন কর্মীদের নজরে আসছে, ততক্ষণে সব ভোঁ-ভাঁ! তবে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সপ্তাহ খানেক আগে এমনই একটি দলকে কর্মীরা উল্টো দিকের মলের সামনে থেকে ধরে ফেলেন। তাঁরা অবশ্য একটুও বিব্রত না হয়ে বলেন, ‘‘ওহ্, টাকা দেওয়া হয়নি। না? ভুলে গিয়েছি।’’
গত পাঁচ-ছ’বছর ধরে এমন একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। আগে বেশি হত। টেবিলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর কিছুটা হলেও শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তবে এখনও মাসে গড়ে দু’-তিনটি এ রকম ঘটনা ঘটে। নিছক নেশার ঘোরে ‘ভুলে গিয়েছি’ বলে যে লোকেরা চলে যাচ্ছেন, তা নয়। অনেকে করছেন সচেতন ভাবে। এই ‘অপরাধীদের’ নির্দিষ্ট কোনও বয়স বা জাতও নেই। ছেলে-বুড়ো, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত— কেউ বাদ নেই।
সব টেবিলে অবশ্য এই বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়নি। শুধু মাঝের টেবিলগুলিতেই এর প্রয়োজন হয়েছে। দু’ধারের টেবিলগুলি চার দিক ঢাকা কেবিনের মধ্যে। যাঁরা স্ত্রী-পরিবার বা জোড়ায় আসেন, তাঁদের জন্য ওই কেবিন। তাঁদের একজন বাইরে ধূমপান করতে গেলেও কেউ না কেউ কেবিনে থাকেনই।
দ্বিতীয় আর একটি দুর্বুদ্ধিও আছে। সেটি নিজের কানে শোনা এক কর্মী বললেন, ‘‘সে দিন হঠাৎ তিন নম্বর টেবিলে শুনি, চার জন ফিসফিস করে বলাবলি করছে, প্লেটটা হাফ সাফ করে বলব খাবার বাজে। তখন আর এক প্লেট দিয়ে দেবে। নেহাত শুনে ফেলেছিলাম! না হলে ওখানে মুফতে আরও এক প্লেট চিলি পর্ক দিতে হত। আসলে খদ্দেররা তো আমাদের কাছে ভগবান। ওঁরা খাবার নিয়ে অভিযোগ করলে আমরা আর একটুও কথা বাড়াই না। সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি এক প্লেট দিয়ে দিই। সেই সুযোগও ছাড়েন না অনেকে।’’
বিলের বকেয়া টাকা আসে কোথা থেকে? এ ভাবে চলতে থাকলে তো ব্যবসা লাটে উঠবে! এখানেই কর্মীদের অসহায়তা। কারণ, বাকি থাকা বিলের টাকা দিতে হয় কর্মীদেরই। তাঁদের কাছে এটা এখন স্বাভাবিক ঘটনা। তাঁদেরই একজনের কথায়, ‘‘আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্বে দুটো করে টেবিল থাকে। যাঁর টেবিলে এই ঘটনা ঘটে, তাঁকে সেই বিল মেটাতে হয়। মালিক শুনবেন কেন? এখানে ১০ বছর কাজ করছি। হিসাব করে দেখিনি। কিন্তু মনে হয় নিজের পকেট থেকে এখনও পর্যন্ত ২৫-৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।’’
এই টাকার অঙ্ক অনেক সময় মালিকের হিসাবের বাইরে থাকে। কারণ, বিল না মেটানোর ঘটনা ঘটলে অনেক সময়েই কর্মীরা মালিককে জানান না। জানালে উল্টো বিপদ হতে পারে। ম্যানেজার মিলন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ওঁদের উপর অমনোযোগিতার অভিযোগ আসতে পারে। বলা হতে পারে, ওঁরাই মন দিয়ে কাজ করছেন না। ঠিক মতো খেয়াল রাখছেন না। তাই অনেকেই আমাদের কিছু না বলে চুপি চুপি টাকাটা নিজের পকেট থেকে দিয়ে দেন। তৎক্ষণাৎ দিতে না পারলে বেতন থেকে টাকাটা কেটে নেওয়া হয়। এঁদের বেতন তো খুব বেশি নয়। তাই খারাপ লাগে। আমাদেরও হাত-পা বাঁধা। মালিককে তো দিনের শেষে হিসাব দিতে হবে। মালিকের অনুমতি নিয়েই আমরা প্রত্যেক টেবিলে এই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।’’
কিন্তু তাতে কি কাজ হয়েছে? ম্যানেজার জানালেন, ‘‘অবশ্যই কাজ হয়েছে। খেতে এসে চেয়ারে বসেই যদি কেউ এমন লেখা দেখে, তা হলে হয়ত বিবেকে লাগে। মনে হয় মানুষের বিবেকে খানিকটা হলেও লেগেছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy