২২ ডিসেম্বর ২০২৪
bankura

‘দপ্তর’ কাঁধে ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি ছুটছেন শিক্ষক কমলাকান্ত

বাঁকুড়ার একেবারে পিছিয়ে পড়া ব্লক হীড়বাঁধের তিলাবনী হাইস্কুলের পড়ুয়ারা করোনাকালেও নিয়মিত পড়া চালিয়ে গিয়েছে। সৌজন্যে শিক্ষক কমলাকান্ত।

গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।

শিখা মুখোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:৫৬
Share: Save:

তিনিও কমলাকান্ত। তবে চক্রবর্তী নন। কমলাকান্ত হেমব্রম। ‘দপ্তর’ একটা আছে বটে। তবে আপাতত তা বন্ধ। আর সেই বন্ধ ‘দপ্তর’ সঙ্গে নিয়ে তিনি সাইকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গ্রামে গ্রামে, মাইলের পর মাইল, প্রত্যেক দিন।করোনাকালে বন্ধ সব স্কুল। পড়াশোনা যতটুকু চলছে তা অনলাইনে। কিন্তু হীড়বাঁধে অধিকাংশ পড়ুয়ার পরিবারে কোনও স্মার্ট ফোন নেই। দু’-এক জনের আছে বটে! তবে ইন্টারনেট পরিষেবার যা হাল, তাতে অনলাইন ক্লাস করা অসম্ভব। সকলেই ভেবেছিলেন এ বার পড়াশোনা লাটে উঠবে। তবে তা হয়নি। বাঁকুড়ার একেবারে পিছিয়ে পড়া ব্লক হীড়বাঁধের তিলাবনি হাইস্কুলের পড়ুয়ারা এই করোনাকালেও নিয়মিত পড়া চালিয়ে গিয়েছে। সৌজন্যে ওই স্কুলেরই শিক্ষক কমলাকান্ত। করোনা সংক্রমণের ভয় নিয়েও সাইকেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। স্কুল যেতে না পেরে যদি ওরা পড়াশোনা ছেড়ে দেয়! সেই ভয়কেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন কমলাকান্ত।

সকাল সকাল সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গে প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র, খাতা, পেন, জ্যামিতিবাক্স। আর শুকনো মুড়ির প্যাকেট। তার মধ্যে কয়েকটা ভাঙা বিস্কুট। ঘুরে বেড়ান হীড়বাঁধের প্রত্যন্ত সব গ্রামের পাড়ায় পাড়ায়। সান্ডি, ভোজদা, পলাশবনি, তিলাবনি, ত্রিশুলিয়া, বেলকানালি, বাউরিডি-র মতো গ্রামগুলিতেই তো থাকে তাঁর স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। মাসের পর মাস যারা স্কুলের মুখই দেখেনি প্রায়। কমলাকান্ত ওদের পড়ান। প্রশ্নপত্র দেন। উত্তরপত্র বাড়ি নিয়ে আসেন। আবার পরের সপ্তাহে সেই উত্তরপত্র ফেরত দিয়ে বুঝিয়ে দেন, কোথায় কোথায় ভুল ছিল। কমলাকান্ত বলছিলেন, ‘‘বছর দেড়েক আগে সব কিছু ওলোটপালোট করে দেয় এই করোনা। স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ হারিয়ে মনমরা হয়ে পড়ছিলাম। দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ। অভাবী পড়ুয়াদের অধিকাংশের তো স্মার্ট ফোন নেই। ধীরে ধীরে ওরা পড়াশোনার রেওয়াজ থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল।’’

বাঁকুড়ার একেবারে পিছিয়ে পড়া ব্লক হীড়বাঁধের তিলাবনী হাইস্কুলের পড়ুয়ারা এই করোনাকালেও নিয়মিত পড়া চালিয়ে গিয়েছে। সৌজন্যে ওই স্কুলেরই শিক্ষক কমলাকান্ত।

বাঁকুড়ার একেবারে পিছিয়ে পড়া ব্লক হীড়বাঁধের তিলাবনী হাইস্কুলের পড়ুয়ারা এই করোনাকালেও নিয়মিত পড়া চালিয়ে গিয়েছে। সৌজন্যে ওই স্কুলেরই শিক্ষক কমলাকান্ত।

কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই কমলাকান্তের মাথায় আসে, স্কুলে ওরা না আসতে পারলেও, স্কুলটাকে যদি ওদের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়! যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বুদ্ধি খাটিয়ে বার করলেন উপায়। নিজেই বিভিন্ন ধরনের বই ঘেঁটে তৈরি করতে শুরু করলেন নানা ধরনের ‘আক্টিভিটি টাস্ক’। এর পর সাইকেলে ব্যাগ ভর্তি করে সে সব নিয়ে পৌঁছে যেতে শুরু করলেন পড়ুয়াদের বাড়ি বাড়ি। ওদের ডেকে ডেকে সেই ‘আক্টিভিটি টাস্ক’ ধরিয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার উত্তর তৈরি রাখতে বলেন। নির্দিষ্ট দিন অন্তর ফের পড়ুয়াদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করতে থাকেন উত্তরপত্র। একই সঙ্গে চলে পড়ানোর কাজও। মাস্টারমশাইকে কাছে পেয়ে পড়ুয়ারাও নিজের বাড়িতে বসেই বুঝে নিতে থাকল পড়াশোনার বিষয়গুলি। কমলাকান্তের চালু করা নতুন এই পদ্ধতি এখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে পড়ুয়াদের কাছে।

কমলাকান্তের নিজের পড়াশোনা একেবারেই মসৃণ ভাবে হয়নি। বলছিলেন, ‘‘পরিবারে তেমন আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। কষ্ট করে কলেজের পড়া শেষ করে বেছে নিয়েছিলাম শারীরশিক্ষাকে। ছোট থেকেই এলাকায় ভাল ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিত ছিলাম। এর পর ১৯৯৫ সালে ইন্দাস ব্লকের শাসপুর হাইস্কুলে শারীরশিক্ষার শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দিই। ২০০৭ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পাই বাড়ির কাছে তিলাবনী হাইস্কুলে। বিষয় একই।’’

শারীরশিক্ষার শিক্ষক হলেও তিনি স্বেচ্ছায় পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির অঙ্কের ক্লাসও নেন। স্কুলের সব শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কাছে ‘কমলাকান্তবাবু’ যেন মুশকিল আসান। অভাবে কোনও ছাত্রের বই কেনা হয়নি, কার পেন নেই, কোন ছাত্রীর অভিভাবক কিনে দিতে পারেননি জ্যামিতিবাক্স— সব তাঁর নখদর্পণে। ছাত্রছাত্রীদের সেই অভাব খুশিমনে পূরণ করেন তিনি। এখনও গ্রামে গ্রামে ঘোরার সময় এ সব খবরাখবর রাখেন। আপাদমস্তক স্কুলঅন্তপ্রাণ কমলাকান্ত নিজের দীর্ঘ চাকরি জীবনে ছুটি নিয়েছেন হাতে গোনা কয়েক দিন। তা-ও আবার নিজের অসুস্থ ছেলের চিকিৎসার জন্য ভিন্‌রাজ্যে যাওয়ার জন্য নেহাতই বাধ্য হয়ে। গরম বা পুজোর ছুটিতেও নিয়মিত স্কুলে যান কমলাকান্ত। স্কুল চত্বরে নিজের হাতে লাগানো ফুল ও ফলের গাছের পরিচর্যা করতে হয় যে! স্ত্রী-পুত্র নিয়ে কমলাকান্তের সংসার। স্ত্রী অঞ্জলি হেমব্রম স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলে পড়ান। আর শারীরিক ভাবে অসুস্থ একমাত্র ছেলে এ বছর স্নাতক উত্তীর্ণ হয়েছেন।

শারীরশিক্ষার শিক্ষক হলেও তিনি স্বেচ্ছায় পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির অঙ্কের ক্লাসও নেন কমলাকান্ত হেমব্রম।

শারীরশিক্ষার শিক্ষক হলেও তিনি স্বেচ্ছায় পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির অঙ্কের ক্লাসও নেন কমলাকান্ত হেমব্রম।

সংসার সামলে প্রতিদিন রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পড়ুয়াদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাওয়া, কষ্ট হয় না? কমলাকান্ত বলেন, “কষ্ট হয় না, তা ঠিক নয়। কিন্ত কী আর করি! আমার স্কুলের অধিকাংশ পড়ুয়া যে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেটের অভাবে অনলাইনে তাদের পড়ানো সম্ভব নয়। অভিভাবকরাও নিরুপায়। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে এ ছাড়া আর কোনও উপায় খুঁজে পাইনি। সব কিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত যত কষ্টই হোক এ ভাবেই আমি পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাব।”

তাই ছুটছেন কমলাকান্ত। ছাত্রছাত্রীদের আলো দেখানোই তো শুধু নয়, তাঁর এই দৌড় সমাজকেও পথ দেখাচ্ছে... দেখিয়ে যাচ্ছে... দেখিয়ে যাবে...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy