২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Inspirational story

বালিকাবেলা বাঁচাতে নারী সেজে পথে বেরোন হুগলির ‘হেডস্যার’, নিজের হাতে সাজিয়ে দেন স্ত্রী

বহুরূপী সাজতে পোশাক কিনেছেন। কিনেছেন রূপটানের নানা সরঞ্জাম। স্ত্রী কাবেরী মুখোপাধ্যায় এখনও প্রতি দিন দেবাশিসকে নিজের হাতে সাজিয়ে দেন।

স্কুলে ভবিষ্যতের নাগরিকদের পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাওয়া গোলাপসুন্দরী জীবনের সৌন্দর্যের কথাও বলতে চান।

স্কুলে ভবিষ্যতের নাগরিকদের পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাওয়া গোলাপসুন্দরী জীবনের সৌন্দর্যের কথাও বলতে চান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিদিশা সরকার
খানাকুল শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২২ ০৮:৫৬
Share: Save:

পড়ানো তাঁর পেশা। শিক্ষা দেওয়া তাঁর নেশা। এই টানেই বছর বাহান্নর পুরুষমানুষটি নারী সেজে বেরিয়ে পড়েন পথে পথে। হুগলির খানাকুলে মাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক দেবাশিস মুখোপাধ্যায় তখন পরিচয় বদলে গোলাপসুন্দরী। বেশ তাঁর নারীর। কণ্ঠে তাঁর গান।

ছোট ছোট পঙ্‌ক্তির ছড়া। তাতে বসানো পাঁচালির সুর। কখনও কোনও স্কুলের গেটের সামনে সেটাই গলা ছেড়ে গাইতে থাকেন। বুকের কাছে রাখা ছোট্ট স্টিলের পাত্রে আঙুলের টোকায় তাল ঠোকেন। পায়ের ঘুঙুরে ওঠে শব্দছন্দ। গোলাপসুন্দরী গাইছেন, ‘ছেলেদের ২১ আর মেয়েদের ১৮ হলে, তবেই তাদের দু’জনের বিয়ে দেওয়া চলে…।’ পরনে জরির কাজ করা লাল র‌্যাপার। সুতির কুর্তিটাও লাল। গলায় নানা রঙের ছোট ছোট অনেক স্কার্ফ। ফর্সা গালে লাল রঙের টান। চোখে টানা কাজল। কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ। হাতে সোনালি রঙের চুড়। গাইতে থাকেন নিজেরই লেখা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতার ছড়া-গান।

ইচ্ছা আর ভাবনার সূত্রপাত বছরখানেক আগে। শুরু করেছেন মাস সাতেক। গোলাপসুন্দরী হয়ে কোথায় না কোথায় চলেছেন! শ্যাওড়াফুলি থেকে পায়ে হেঁটে তারকেশ্বরের শ্রাবণীমেলা। কৌশিকী অমাবস্যার ভিড়-ঠাসা তারাপীঠ। হেঁটে খানাকুল থেকে কলকাতা। গিয়েছেন বিধানসভাতেও। দেবাশিসের লক্ষ্য একটাই, বাল্যবিবাহ বন্ধ হোক। আর সে কারণেই নারীরূপে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিজের গ্রাম, পাশের গ্রাম, ভিন‌্‌জেলা, এমনকি ভিন্‌রাজ্যেও। দেবাশিসের কথায়, ‘‘আমি চাই বাল্যবিবাহের মতো ব্যাধি সমাজ থেকে দূর হোক। চিকিৎসকেরাই তো বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনও মেয়ের যদি বাচ্চা হয়, তা হলে মা-বাচ্চা দু’জনেরই অপুষ্টিতে ভোগার সম্ভাবনা প্রবল। নানা ধরনের জটিল অসুখও দেখা দেয়। মূলত, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া সমাজের পরিবারে এই ব্যাধি বেশি। এ জন্য দায়ী মূলত অশিক্ষা। তাই মানুষকে শিক্ষিত হতে হবে। শুধু বাচ্চাদের পড়ালেই হবে না। বড়দেরও শিক্ষা দিতে হবে। আমি শিক্ষক হিসাবে সে কাজটাই করতে চাইছি।’’ এর পরেই দেবাশিসের আক্ষেপ, ‘‘একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কমবয়সি মেয়েদের কেন বিয়ে দিতে নেই তা নিয়ে প্রচার করতে হচ্ছে, এটাই লজ্জার।’’

 দেবাশিসের লক্ষ্য একটাই, বাল্যবিবাহ বন্ধ হোক।

দেবাশিসের লক্ষ্য একটাই, বাল্যবিবাহ বন্ধ হোক।

দেবাশিসের বাড়ি হুগলির আরামবাগের তিলকচক গ্রামে। স্কুল পাশের গ্রামেই। সেটা অবশ্য খানাকুল থানার মধ্যে পড়ে। বছর বাইশ ধরে শিক্ষকতা করছেন। বছর দু-এক আগে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রথম বার বহুরূপী সেজে এলাকায় ডেঙ্গি সম্পর্কে সচেতন করতে বেরিয়েছিলেন। তারও একটা পটভূমি ছিল। দেবাশিস কলকাতার একটি নাটকের দলে অভিনয় করতেন। সেই সময় বীরভূমের এক গ্রামে বহুরূপীদের সঙ্গে দেখা করতে যান থিয়েটারের কাজেই। তখন থেকেই মাথায় ছিল, নিজেও কখনও বহুরূপী সাজবেন। ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকে দেবাশিস জানতেন, বহুরূপী এলেই পাড়ার শিশু, কিশোরদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়। দলে দলে মানুষ বেরিয়ে আসেন বহুরূপীদের দেখতে। মনে হয়েছিল, এমন কৌশল কাজে লাগালে যে কোনও প্রচারের কাজ খুব সহজ হয়ে যায়।

বছরখানেক আগে দেবাশিসের নজরে আসে নিজের এলাকার একটি বাল্যবিবাহের খবর। তার পরেই তিনি ঠিক করেছিলেন, বহুরূপী সেজে মানুষকে এই ‘সামাজিক ব্যাধি’ সম্পর্কে সতর্ক করবেন। সচেতন করবেন। প্রথম দিকে অপ্রতিভ লাগত। তবে মানুষের কাছে তাঁর সেজে ওঠা এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল যে, একটু একটু করে ভরসা পেতে শুরু করেন দেবাশিস। নিজের কথাটা বলতে শুরু করেন। তার পর একটা সময় লিখতে শুরু করলেন ছড়া। তাতে প্রচলিত সুর বসালেন। পায়ে বাঁধলেন ঘুঙুর। নেচে, গেয়ে শরীরী ভঙ্গিমায় বাবা-মায়েদের বোঝাতে লাগলেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সন্তানদের বিয়ে দিতে হয়। তার আগে কোনও মতেই নয়। কারণ, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য একটা ন্যূনতম বয়সের প্রয়োজন হয়। দেবাশিস তাই গাইছেন, ‘১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেবে না, মা-বাবা হয়ে তাদের বিপদে ফেলবে না’, ‘অল্প বয়সে বিয়ে দিলে মেয়ে পড়বে রোগে, তোমাদেরই কষ্ট হবে মেয়ে যদি ভোগে’, ‘মেয়েদের ভাল করে লেখাপড়া শেখাও, লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের দেশ গঠনে লাগাও।’ এমন হাজারো পঙ‌্ক্তি লিখেছেন দেবাশিস।

শিক্ষকতা এবং সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি বহুরূপী শিল্পকেও বাঁচিয়ে রাখতে চান দেবাশিস।

শিক্ষকতা এবং সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি বহুরূপী শিল্পকেও বাঁচিয়ে রাখতে চান দেবাশিস।

একই সঙ্গে বহুরূপীদের সম্পর্কেও উৎসাহ বেড়েছে দেবাশিসের। বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার বহু গ্রামে একটা সময় বহুরূপীদের রমরমা ছিল। এখন অবশ্য কদর কমেছে। দেবাশিস জানাচ্ছেন— হুগলির বৈঁচি, তারকেশ্বর, চুঁচুড়া এবং বীরভূম জেলার লাভপুরের কাছে কয়েক জন কোনও রকমে টিকিয়ে রেখেছেন শিল্পটিকে। সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা’ গল্পের বহুরূপী সুচাঁদ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের শ্রীনাথ বহুরূপী, সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্প— এ সব মাথায় ঘোরে দেবাশিসের। তাই তিনি শিক্ষকতা এবং সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি বহুরূপী শিল্পকেও বাঁচিয়ে রাখতে চান।

পোশাক কিনেছেন। কিনেছেন রূপটানের সরঞ্জাম। স্ত্রী কাবেরী মুখোপাধ্যায় প্রতি ছুটির দিনে তাঁকে নিজের হাতে সাজিয়ে দেন। স্বামীকে গোলাপসুন্দরীর রূপ দেওয়া কাবেরীর কথায়, ‘‘ও যে কাজটা করছে, তার উদ্দেশ্য অনেক মহৎ। আমাদের গ্রাম তো বটেই, আশপাশের অনেক গ্রামেই কমবয়সিদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ও সেটা আটকাতে চেয়েছে। যদি ওর প্রচারে কিছুটা কাজ হয়, তা হলে আমাদেরই মঙ্গল। আর সাজিয়ে দিই, কারণ, ও তো মেকআপ করতে পারে না। কখনও করেনি। ও সব পোশাকও পরেনি। আমিই তাই দায়িত্ব নিয়েছি।’’ বি টেক পাশ করেছেন দেবাশিস-কাবেরীর ছেলে দীপ্তম। মেয়ে দীপিকা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারের কাজে যান, সাহায্যও করেন। কিন্তু বাবার এই নারী সাজাটা খুব একটা পছন্দ করে না মেয়ে। কাবেরী বছর বারোর দীপিকাকে বুঝিয়েছেন, তার মতো কমবসয়িদের বিপদ থেকে বাঁচাতেই বাবা গোলাপসুন্দরী সাজেন।

জেলা প্রশাসনের উপরতলাও গোলাপসুন্দরীর কথা জানে। হুগলির জেলাশাসক পি দীপাপপ্রিয়া যেমন বলছেন, ‘‘দেবাশিসবাবুর এই গোলাপসুন্দরী হয়ে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচারকাজের কথা শুনেছি। বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে জেলা জুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। র‌্যালিও হয়। আমরা সরকারি ওই সব অনুষ্ঠানে ওঁকে ডাকার কথা ভেবেছি। আসলে বাল্যবিবাহ রুখতে সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেবাশিসবাবু সেই কাজটা করছেন। প্রশংসনীয় কাজ। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে সাহায্য করায় উদ্যোগী হব।’’

স্কুলে ভবিষ্যতের নাগিরকদের পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাওয়া গোলাপসুন্দরী জীবনের সৌন্দর্যের কথাও বলতে চান। তাঁকে ফোন করলে ‘কলার টিউন’ বাজে কিশোরের গলায় বাপ্পি লাহিড়ির সুরে ‘জীবন মিটানা হ্যায় দিওয়ানাপন, কোই প্যার জীবন সে প্যারা নেহি…’— জীবনটা কাটাতে হবে ভালবেসেই, কোনও প্রেমই জীবনের থেকে বড় নয়। গোলাপসুন্দরীর ব্যাখ্যা, ‘‘কত জনকেই তো দেখলাম বেঁচে থাকার কোনও একটা ধাপে ব্যর্থ হয়ে জীবনটাই শেষ করে দিয়েছে। আমার কয়েক জন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীও আজ দুনিয়ায় নেই। তাই যাঁরা আমাকে ফোন করেন, তাঁদের আমি এ কথাটাই বোঝাতে চাই, জীবনের থেকে প্রিয় আর কিছুই হতে পারে না। নেই-ও।’’ গলা ধরে আসে গোলাপসুন্দরীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy