‘ঘড়িবাবু’র ৩৬৫ দিনের রুটিনে কোথাও এক মিনিটের জন্য লেট নেই। গ্রামের অনেকে তো স্মরণকে দেখে সময় মাপেন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মুশকিলে পড়লেই তাঁর শরণে। বিপদে পড়লেই তাঁকে স্মরণ। ভগবান নন, তিনি এক জলজ্যান্ত মুশকিল আসান।বছর পঁয়ষট্টির এই বৃদ্ধ থাকেন নদিয়ার করিমপুরে। অন্যের কাজে কখনও মুখে ‘না’ নেই। ভোর সাড়ে চারটে থেকে রাত সাড়ে ন’টা— ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দৌড়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোই তাঁর নেশা। পেশাদারিত্বও আছে সেই নেশার কাজে। নিয়ম মেনে, সময় মেনে কাজ করে চলেন। অফিস করার মতো প্রায়! তবে কারও উপকার করে কোনও রকমের আর্থিক প্রাপ্তি তিনি চান না। পারিশ্রমিক বড় জোর জর্দাপান। ব্যস! ব্যাঙ্কে একটা বহু পুরনো অ্যাকাউন্ট আছে বটে, কিন্তু তাতে ফুটো কড়িটিও নেই। ও হ্যাঁ, পকেটও ফাঁকাই থাকে। কারণ, তাঁর তো টাকাপয়সার প্রয়োজনই পড়ে না!
নাম স্মরণ। স্মরণ বাগ। ছোটখাটো চেহারা। পাঁচ ফুট দুইয়ের স্মরণ করিমপুরের ধোড়াদহ গ্রামে চৌধুরীবাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। তিনি সে বাড়ির কেয়ারটেকারও বটে। তবে বাড়ির ‘কেয়ার’ তিনি কমই করেন। বরং বেশি খেয়াল রাখেন গোটা গ্রামের। ধোড়াদহ গ্রাম থেকে কাছের সদর বলতে করিমপুর। ব্লক সদর। সেখানেই ব্যাঙ্ক থেকে বিডিও অফিস, বিদ্যুৎ অফিস থেকে হাসপাতাল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বড় দোকানও সেখানে। গ্রাম থেকে সাত কিলোমিটার দূরের সেই ব্লক সদরে গিয়ে কাজকম্ম মেটানোর মতো সময় বা চেনাজানা থাকে না অনেকের। তাতে কী! স্মরণ আছেন তো। তিনিই সবটা দেখে দেন। করেও দেন।
এ হেন স্মরণের প্রাত্যহিক রুটিনটা বড্ড অন্য রকমের।
ঘুম থেকে ওঠেন ভোর সাড়ে চারটেয়। তার পর গ্রাম ঘুরে ফুল তুলে বেড়ান। সেই ফুল পৌঁছে দেন বাড়ি বাড়ি। মহিলাদের পুজোর কাজে লাগে। সূর্য পুব আকাশে ওঠার আগেই স্নান সেরে ফেলেন। তার পর সকালের জলখাবার। মেনুতে রোজই মুড়ি আর কলা। সঙ্গে খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। এর পর ঠিক সাতটায় বেরিয়ে পড়া— ট্রাউজার্সের ভিতরে ফুলহাতা শার্ট গুঁজে। বুকপকেটে দুটো কলম। মাথায় একটা গল্ফ টুপি। সাইকেলে স্মরণ যাচ্ছেন ধোড়াদহ বাজারে। সেখানে দীপক সাহার পানের দোকানই স্মরণের ‘চেম্বার’।
সকাল ঠিক আটটায় স্মরণকে পাওয়া যায় করিমপুর বিদ্যুৎ অফিসে। —নিজস্ব চিত্র।
দীপকের পানের দোকানে তত ক্ষণে চলে এসেছেন মানুষজন। কারও বিদ্যুতের বিল জমা দিতে হবে। কারও বাড়িতে বিদ্যুতের সমস্যা। কারও পেনশন তুলে এনে দিতে হবে। কারও বাচ্চার দুধ আনতে হবে সদরের বড় দোকান থেকে। কারও আবার আধার কার্ডে সংশোধন। কেউ ওষুধ আনতে দিয়েছেন। কাজের লিস্ট এবং টাকাপয়সা সব বুঝে নিয়ে স্মরণ ফের সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেন। তার আগে যদিও দীপক তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন জর্দাপান-বন্দি চারটি কাগজের টোপলা। একটা গালে আর বাকি তিনটে পকেটে চালান করে স্মরণের পরবর্তী গন্তব্য ইলেকট্রিক অফিস।
সকাল ঠিক ৮টায় স্মরণকে পাওয়া যায় করিমপুর বিদ্যুৎ অফিসে। বিদ্যুৎ বিলের টাকাপয়সা জমা দিয়ে, লোকজনের নানান সমস্যার কথা লিখিয়ে স্মরণ ঠিক সাড়ে আটটায় পৌঁছন করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। সাইকেল রেখে সোজা তিনি যান রোগীদের যেখান থেকে ওষুধপত্র দেওয়া হয়, সেই ফার্মাসিতে। স্মরণের বাবা ছিলেন ফার্মাসিস্ট। সেই সূত্রেই তাঁর এ ব্যাপারে খানিক ব্যুৎপত্তি রয়েছে। কোন ওষুধ কখন খেতে হবে, কোন কোন ডোজে খেতে হবে— তার সবটাই তিনি নিজের হাতে লিখে দেন রোগী বা রোগীর পরিবারের কাউকে। হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট জয়ন্ত বিশ্বাস যেমন বলছেন, ‘‘স্মরণদা প্রত্যেক দিন নিয়ম করে আউটডোরের সময়টায় আমাদের সাহায্য করেন। উনি বিনা পারিশ্রমিকের সরকারি কর্মচারী।’’
কোন ওষুধ কখন খেতে হবে, কোন কোন ডোজে খেতে হবে— তার সবটাই তিনি নিজের হাতে লিখে দেন রোগী বা রোগীর পরিবারের কাউকে। —নিজস্ব চিত্র।
ঘণ্টাদুয়েক সেই কাজ করার পর স্মরণ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘রাউন্ড’ দিতে বেরোন। ঘড়িতে তখন সাড়ে ১০টা। কার কখন কী ওষুধ প্রয়োজন, বাইরে থেকে কাউকে ওষুধ এনে দিতে হবে কি না, কার এক্সরে করাতে হবে বা অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষা, কাকে অ্যাম্বুল্যান্সে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার রয়েছে— এ সবের খবর নিয়ে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে রয়েছেন স্মরণ। ফুরসৎ নেই তাঁর।
বেলা ঠিক ১১টায় স্মরণ পৌঁছন প্রয়াত দীপেন চৌধুরীর করিমপুরের বাড়িতে। তাঁর ‘দীপেনদা’র বাড়িতেই এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট। তার পর দুপুরের খাওয়াদাওয়া। ফের বেরিয়ে পড়া ১টায়। এ বারের গন্তব্য করিমপুরের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক। অন্যের টাকা জমা-তোলা করে সোজা বিডিও অফিস। সেখানে কারও আধার, কারও বা ভোটার, কারও আবার লক্ষ্মীর ভান্ডার— সবটা সামলে সাড়ে চারটে নাগাদ ফের ধোড়াদহের উদ্দেশে সাইকেল ফেরান তিনি। তার আগে যদিও রাতের খাবারের কৌটোটা নিয়ে নেন ‘দীপেনদা’র বাড়ি থেকে। ফিরতি পথে ধোড়াদহ বাজারে দীপকের দোকানে সবাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরেন ঠিক পাঁচটায়।
এই যে স্মরণ পাঁচটায় বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু কাজ শেষ হল না! পাড়ার লোকেরও তো নানা সমস্যা থাকে। কয়েক মুহূর্ত ঘরে কাটিয়ে তিনি পাড়ায় বেরোন। কার কী কী সমস্যা আছে, শোনেন। প্রয়োজনীয় সাহায্যও করেন। সাতটায় ফের ঘরে ফেরেন। এ বার দিনের মতো ফেরা। নিজের পড়াশোনা আর রেডিয়ো শোনা। সাড়ে ৯টা অবধি নিজের সঙ্গে সময় কাটানো। তার পর রাতের খাওয়াদাওয়া। ঠিক ১০টায় বিছানা।
এই হল ‘ঘড়িবাবু’র ৩৬৫ দিনের রুটিন। কোথাও এক মিনিটের জন্য লেট নেই। গ্রামের অনেকে তো স্মরণকে দেখে সময় মাপেন। তাঁর আসা-যাওয়ার সবটাই ঘড়ির কাঁটা মেপে। এর মধ্যেই অনেকে ফোন করেন। কারও বাড়িতে অতিথি এসেছেন। মিষ্টি আনতে হবে। পরের দিনের কাজের অনেক ‘বরাত’ই মোবাইলে আসে। সে কারণে মোবাইলে সারা ক্ষণ চার্জ ‘ফুল’ রাখেন। যাতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কখনও কোনও সমস্যা না হয়।
ফিরতি পথে ধোড়াদহ বাজারে দীপকের দোকানে সবাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরেন ঠিক পাঁচটায়। —নিজস্ব চিত্র।
ধোড়াদহেই জন্ম স্মরণের। মামারবাড়িতে। মায়ের দিক থেকে কোনও এক সূত্রে আত্মীয় এই চৌধুরীবাড়ির বাসিন্দারা। সেই সূত্রে দেবাশিস চৌধুরী তাঁকে চিলেকোঠার ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। সেই সূত্রেই দীপেন চৌধুরীর বাড়িতে দুপুর-রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু অকৃতদার স্মরণের চলে কী ভাবে? কারও কাছ থেকে তো একটা পয়সাও নেন না! স্মরণ বলছেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই আমার চাহিদা খুবই কম। ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট আছে বটে, কিন্তু তাতে দীর্ঘ দিন ধরেই কোনও টাকাপয়সা নেই। আমার কাছেও টাকা থাকে না। কোন কাজে টাকা লাগবে! থাকাটা এই বাড়িতে। আর খাওয়াদাওয়া তো দীপেনদার বাড়িতেই হয়ে যায়। বাকিটার জন্য ঈশ্বর আছেন।’’
সারা দিনে নেই নেই করে ১৭ কিলোমিটার সাইকেল চালান স্মরণ। গ্রাম থেকে করিমপুর ৭ কিলোমিটার। যাতায়াতের সঙ্গে একটু এ দিক ও দিক জুড়ে ওটা ১৭ হয়ে যায় রোজ। গ্রামের বাসিন্দা প্রিয়া চৌধুরী যেমন বলছেন, ‘‘আমার পরিবারের তো সব কাজই উনি করে দেন। আমরা তো অতশত বুঝি না। আর কাজ ফেলে সদরে গিয়ে ও সব করার অনেক ঝামেলা। সবটাই স্মরণদা করেন।’’ পানের দোকানদার দীপকও অত্যন্ত পছন্দ করেন স্মরণকে। তিনি যেমন বলছেন, ‘‘প্রতি দিন সকাল সাতটায় আমার এখানে আসেন স্মরণদা। সওয়া সাতটায় ঠিক এখান থেকে কাজ সেরে বেরিয়ে যান। ওঁকে উপহার হিসেবে ৪টে জর্দা পান দিই। সারা দিন লোকটা সমাজসেবা করেন। ওঁর জন্য এটুকু করতে না পারলে খারাপ লাগবে।’’
যে মানুষটার সঙ্গে সকলের এত ভাল যোগাযোগ, তাঁকে নিয়ে রাজনৈতিক টানাহেঁচড়া হয় না? স্মরণ বলছেন, ‘‘হয় তো। প্রত্যেক বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় আমাকে সকলে মিলে অনুরোধ করেন। আমি বলি, সমাজসেবার জন্য রাজনীতি করার প্রয়োজন পড়ে না। তাতে কাউকে না কাউকে দুঃখ দেওয়া হয়ে যায়। যে কারণে তো সংসারেও মন দিলাম না। সংসার আর সমাজসেবা একসঙ্গে কখনও হয় না। হতে পারে না।’’
স্মরণের চিলেকোঠার ঘরে এখনও হ্যারিকেন আছে। দেওয়ালে একটা ছবি। সেখানে লেখা, ‘রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানে বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিও…’
ধর্মে তিনি আছেন। কিন্তু কর্মই তাঁর আসল ধর্ম। এই কর্মের কারণেই স্মরণ আসলে অনেকের শরণ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy