এপ্রিলে হওয়ার কথা ছিল ৫৮ মিলিমিটার। হয়েছে সাকুল্যে ০.১!
মে মাসে কপাল একটু ভাল। ১২০ মিলিমিটারের জায়গায় কলকাতার প্রাপ্তি ২৪ মিলিমিটার। শুধু কলকাতা নয়। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় এ বার তামাম গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বৃষ্টি-ছবিটা এ রকমই। গুজরাত, মহারাষ্ট্র তো ছার, খাস মরু-রাজ্য রাজস্থান যেখানে গরমকালে অতিবৃষ্টিতে ভেসেছে, সেখানে বাংলায় এ বার অনাবৃষ্টির পরিস্থিতি! ঘূর্ণাবর্তের দৌলতে উত্তরবঙ্গ খানিক ভিজলেও দক্ষিণবঙ্গের ভাঁড়ে মা ভবানী। আবহবিজ্ঞানীরা কাগজপত্র ঘেঁটে বোঝার চেষ্টা করছেন, এমনটা শেষ কবে ঘটেছে।
মৌসম ভবনের খাতা অনুযায়ী, এপ্রিলে কলকাতার প্রাপ্য ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টি, যা নামাতে দু’-তিনটে কালবৈশাখীই যথেষ্ট। এই এপ্রিলে মহানগরের কপালে একটাও জোটেনি। তাই বৃষ্টিও হয়নি। এক দিন হাওড়া-পূর্ব মেদিনীপুরে দুর্বল ঝড়ের সঙ্গে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে। তাতে শূন্য পাওয়ার হাত থেকে বেঁচেছে কলকাতা।
এপ্রিল নিরাশ করলেও আবহবিদেরা আশা ছাড়েননি। বরং এই ভেবে বুক বেঁধেছিলেন যে, মে মাস ঘাটতি পুষিয়ে দেবে। মাসটা শুরুও হয়েছিল কিছুটা আশা জাগিয়ে। ৩ মে মরসুমের প্রথম কালবৈশাখী শহরের বুকে আছড়ে পড়ে। তার জেরে পরের দু’দিনও কিছু বৃষ্টি হয়, দুরন্ত গরমে ক্ষণিক স্বস্তি মেলে। ব্যস। সেখানেই ইতি। নিট ফল: মে’র ২২ তারিখ পর্যন্ত যেখানে মহানগরীতে ১২০ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টি হওয়ার কথা, সেখানে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে!
বস্তুত গোটা পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত এ বার প্রাক-বর্ষার বৃষ্টিপাতের নিরিখে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে। ১ মার্চ থেকে ২১ মে ইস্তক এই তালিকায় সবার আগে দক্ষিণ ভারত। সেখানে ৩৩% বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তার পরে উত্তর-পশ্চিম ভারত (২৬% বেশি)। এমনকী, মধ্য ভারতের রুক্ষ বেহরও স্বাভাবিকের ১০% বাড়তি বৃষ্টি পেয়েছে! “রাজস্থান-গুজরাতের শুখা তল্লাটে গরমে অতিবৃষ্টি বিরল ঘটনা। এ বার সেই বিরল ঘটনাই ঘটেছে।” মন্তব্য করেছেন মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীর।
প্রকৃতির এ হেন বিচিত্র মতি-গতি আবার মৌসম ভবনের শীর্ষ কর্তাদের ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছে। যেমন? চলতি মরসুমের গোড়ায় কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান দফতরের বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেল লক্ষণসিংহ রাঠৌরের নেতৃত্বে মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীরা দেশের বিভিন্ন এলাকার আবহাওয়া সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। যাতে ১৯৫০ থেকে ২০১০ এই ছ’দশকের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে দাবি করা হয়, কলকাতা-সহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা হ্রাস ও বর্ষার আগে-পরে বেশি বৃষ্টির প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।
সেই রিপোর্টে কার্যত জল ঢেলে দিয়েছে। বরং আবহবিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি, গত বিশ বছরে দেশের তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রটি পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম থেকে সরতে সরতে ওড়িশা-গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপরে জাঁকিয়ে বসেছে। পরিণামে এ বার মে মাসে শুকনো গরমের অভূতপূর্ব আঁচ টের পেয়েছে কলকাতা, যা কিনা রাজস্থান-হরিয়ানা বা পুরুলিয়া-বাঁকুড়ারই চেনা চরিত্র ছিল। কলকাতায় টানা ছ’দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে! এ পর্যন্ত তিন ধাপে মোট বারো দিন তাপপ্রবাহের জ্বলুনি সইতে হয়েছে! বয়েছে লু! বর্ষণপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত উত্তর-পূর্বের অসম-মেঘালয়েও বৃষ্টির ঘাটতি চলছে। আর এ সবের প্রেক্ষাপটে ফের প্রশ্ন উঠছে, ভারতের আবহাওয়া কি সত্যিই বদলে গেল?
মৌসম ভবন অবশ্য একে স্থায়ী পরিবর্তন বলতে নারাজ। কিন্তু আবহাওয়ায় আচমকা এমন পরিবর্তন আসা সম্ভব কি না, সেই সংশয়ের নিরসন হচ্ছে না। আবহবিজ্ঞানীদের একাংশের বক্তব্য: প্রকৃতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাবে বহু দিন ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যেমন উত্তর, উত্তর-পশ্চিমে গত তিন বছর যাবৎ তাপপ্রবাহের ঝাঁঝ নিম্নমুখী, মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বৃষ্টিপাতও বেড়েছে। উল্টো দিকে পূর্ব ভারতে দাপট দেখাচ্ছে তাপপ্রবাহ, পাশাপাশি কালবৈশাখী কমেছে। তবে ঘটনা হল, সাময়িক হোক বা স্থায়ী এই পরিবর্তনের হাত ধরে এ বার দুর্বিপাক ঘনাতে পারে পূর্ব ভারতে। মৌসম ভবন এমনিতেই এ বছরে ‘স্বাভাবিকের কম’ বর্ষার প্রাথমিক পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে। প্রত্যাশিত বৃষ্টি না-পেয়ে ভূগর্ভে জলের সঞ্চয় কমেছে। খাল-বিল শুকিয়ে গিয়েছে। জলাধারগুলোয় জল নামছে দ্রুত হারে। চাষবাসে এর কতটা প্রভাব পড়বে, কৃষি দফতর তা ভেবে উদ্বিগ্ন।
এ দিকে বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ দানা বেঁধেছে। তার হাত ধরে বর্ষা মায়ানমার দিয়ে দ্রুত বেগে এগোচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকে নিম্নচাপটির পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে। আবহবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এ দিন সকালে কলকাতার পরিমণ্ডলে এক রাশ মেঘ ঢুকে পড়েছে। তাতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও আর্দ্রতা বেড়েছে হুড়মুড়িয়ে। শুখা গরমে ভাজা-ভাজা হওয়ার বদলে ঘেমে-নেয়ে একশা হতে হচ্ছে।
কিন্তু এই নিম্নচাপ দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি বয়ে আনবে কি? আবহবিদেরা এখনও নিশ্চিত নন।
তাই স্বস্তির বার্তাও মিলছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy