--‘ইস্, কঙ্কনদা! আমি যদি আর একটু লম্বা হতাম, তা হলে চাঁদটাকে ছুঁয়ে ফেলতাম!’ বেজে ওঠে বৃষ্টি।
কোজাগরী র্পূণিমার রাতে জল-জ্যোত্স্নায় ধুয়ে যাচ্ছে গোটা চরাচর। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় পঞ্চলিঙ্গেশ্বর সবুজ-পাহাড়টাও। আর জ্যোত্স্নায় ধুয়ে যাচ্ছে শ্যামলা রুপসী বৃষ্টির ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির ছিপছিপে শরীর। গোটা ব্যক্তিত্ব, গ্ল্যামার।
হু হু হাওয়ায় উড়ছে বৃষ্টির কুঞ্চিত কালো কেশদাম। মেঘ কালো ঢাকাই জামদানির আঁচল। ‘ঝড়ে উড়ে যায় গো চক্ষের আঁচল’ নয়, উড়ে যাচ্ছে বক্ষের আঁচল! ব্যভিচারী বাতাস এলোমেলো করে দিচ্ছে বৃষ্টির কেশবেশ।
--‘শরীর নয়, মনের উচ্চতা বাড়াও, চাঁদটাকে ছুঁতে পারবে। মানুষ পারে না, এমন কিছু নেই এই বিশ্ব সংসারে।’ বলে ওঠে বহুদর্শী বন্ধুপ্রিয় ‘কর্পোরেট’ কঙ্কন।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর সবুজ-পাহাড়টার গায়েই সাদা ধপধপে ‘মহেন্দ্র নিবাস’। আজ সকালেই কঙ্কন সদলে এসেছে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে। বাকিরা নীচের হলঘরে গানে-পানে মেতে আছে। তবে গানের চেয়ে পানটাই বেশি হচ্ছে। মদিরার গ্লাস কঙ্কনের হাতেও। বৃষ্টির পান-পাত্র সামনের ছোট্ট টেবিলে রাখা। চাঁদের আলোয় মহার্ঘ মদের রং আরও মোহময়।
--‘আচ্ছা কঙ্কনদা, আমরা কি চন্দ্রাহত?’
--‘কিছুটা তো বটেই। শোনো, একটা কথা বলি, সাপের বিষ আর অ্যালকোহল, শরীরে ঢুকলে কখনও বেইমানি করে না। ক্রিয়া করবেই। মানে নিজের ধর্ম পালন করবেই। এক ফোঁটা বিষ অথবা ৩০ এম এল মদ, পাঁচ মিনিট পরে পায়ের আঙুল থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করো, ধরা পড়বেই। আর চাঁদের আলো! মানুষকে কিছুটা হলেও বিবশ করবে।’ বলে ওঠে পক্ককেশ কঙ্কন।
রাতে দেশি মুরগির ঝাল ঝাল কষা আর গরম গরম রুটি। সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজ। লেবুর আচার। ‘মহেন্দ্র নিবাস’-এর রাঁধুনির রান্নাট বড় ভাল। নিবাসের মালিক বারিকবাবু বহু খুঁজে এই ‘রত্ন’টি তুলে এনেছেন।
হলুদ পাড় সাদা শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ। কপালে ছোট্ট সাদা টিপ। রে ব্যানে চোখ ঢাকা। বৃষ্টি আজ সকালে অপরূপা। বিরল রূপসী।
কঙ্কন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। শিবাজিও তাই। শিবাজি-পত্নী ববি লাল পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি। লাল ব্লাউজ। আর রিন্টু আকাশ-নীল পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। রিন্টু-পত্নী মিতা সোনালি কাজ করা হলুদ শাড়ি, লাল ব্লাউজ। মিতার চোখে গাঢ রং অ্যাভিয়েটর।
‘মহেন্দ্র নিবাস’ থেকে এক সিগারেট দূরেই পঞ্চলিঙ্গেশ্বর সবুজ-পাহাড়। সবাই সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে। নীচে বসে থাকে একা কঙ্কন। হাঁটুর ব্যথা। কঙ্কন একটু বসেই ফিরে আসে মহেন্দ্র নিবাস-এ।
২৬৩টা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। ওঠার পথে মিতা আর ববির কলকলানি। সচকিত হয়ে ওঠে গাছগাছালি, বহু পাখি। স্বল্প-বাক শিবাজি শুধু হাসতে থাকে রিন্টুর একের পর এক সরস জোকস শুনে। নির্বাক শুধু বৃষ্টি। কঙ্কন একা আছে এই চিন্তা তাকে বাকহীন করে রাখে। বৃষ্টি ভাবে, যে মানুষটা অন্তত আঠারো বার জয় মাতাদি দর্শন করেছে, সে আজ কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙতে কেন এত কষ্ট পায়!
অনেক পাহাড়ি-পথ পার হয়ে ওরা এখন পঞ্চ লিঙ্গের সামনে। পঞ্চ লিঙ্গ+ঈশ্বর=পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। পাঁচটা ছোট লিঙ্গ। পাথরের খাঁজে। পাঁচটা লিঙ্গের ওপর অবিরত ঝরে পড়ছে ঝরনার টলটলে জল। বেশ ঠাণ্ডা। পুরোহিতের কাছ থেকে ফুল বেলপাতা নিয়ে ওরা পুজো সারে। পুজো দেয় না শুধু বৃষ্টি। এক বুক অভিমান নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘কেন কঙ্কনদা এত কষ্ট পাবে?’ এই অভিমান ওকে কষ্ট দেয়। করে তোলে ঈশ্বর অবিশ্বাসী।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর আদতে ওড়িশার নীলগিরি পর্বতশ্রেণির অন্তর্গত অনুচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের শীর্ষে বনদেবীর মন্দির। সামনে ছোট জলাশয়। শীর্ষের উচ্চতা ষোলোশো ফুট। কথিত আছে, রামের বনবাসকালে সীতা পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে পুজো দিতেন। রাজা বনাসুরের আরাধ্য ছিল শিব। তিনিই ওই লিঙ্গগুলো খুঁজে পান। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর ওড়িশার বালেশ্বর জেলায়। বালেশ্বর স্টেশন থেকে দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। ‘মহেন্দ্র নিবাস’-এর বারিকবাবুর গাড়ি সেখান থেকে নিয়ে আসে, আগে বলা থাকলে।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে পুজো সেরে ওরা আবার ‘মহেন্দ্র নিবাস’-এ। কঙ্কনের তত্বাবধানে বারিকবাবু ততক্ষণে গরম লুচি-বেগুন ভাজা-কালো জিরে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সাদা আলু ছেঁচকি তৈরি করে ফেলেছেন। মিতা সঙ্গে এনেছে কুঁদঘাটের ‘সত্যনারায়ণ’-এর ‘কৃষ্ণকলি’। মাঝারি মাপের এই মিষ্টিটার স্বাদ অনবদ্য বললেও কিছু বলা হয় না। কালচে মিষ্টিটার ভিতরে নলেন গুড়ের স্বাদ। বারোমাস, ৩৬৫ দিন, একই স্বাদ, অম্লান, অমলিন। লুচি শেষে সবাই মেতে ওঠে ‘কৃষ্ণকলি’ নিয়ে। কেশর ছড়ানো হাল্কা হলুদ রাজভোগের হাঁড়িটা (সেটাও ‘সত্যনারায়ণ’-এরই) হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় প্রকৃত গোরা রিন্টু।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল গাড়িটার স্টিয়ারিং কঙ্কনের হাতে। গাড়ি ছোটে নীলগিরি, কুলডিহার দিকে। গাড়িটা কঙ্কন বড়ো ভাল চালায়। প্রথমেই জগন্নাথদেবের মন্দির। কঙ্কনের আরাধ্য দেবতা। এই মন্দিরটা বেশ পুরনো। নীলগিরির রাজাদের তৈরি। সামুদ্রিক ঝড় বা প্রাকৃতিক কোনও কারণে পুরীর জগন্নাথদেব মন্দিরের যদি কোনও দিন কোনও ক্ষতি হয় এই আশঙ্কায় এই মন্দিরটা তৈরি করা হয়। জগন্নাথদেবের উদ্দেশে কুঁদঘাটের ‘সত্যনারায়ণ’-এর কেশরভোগ নিবেদন করে মিতা। পৃথুলা মিতা বড়ো বেশি ধার্মিক। সটান শুয়ে পড়ে জগন্নাথদেবের মূর্তির সামনে। নির্মেদ ববি নিবেদন করে ভীমনাগের নরম পাকের সন্দেশ। পছন্দটা অবশ্য রেল-অফিসার শিবাজির। রেল-অফিসার হলে কী হবে, শিবাজি কথা বলে খুব আস্তে। কৃষ্ণ-সুন্দর শিবাজি সূক্ষ্ম মনের মানুষ। কঙ্কনের পাশেই বৃষ্টি। চাঁপার কলি আঙুল শুধু ছুঁয়ে যায় শ্যামলা-সুন্দর কপাল। সবার অলক্ষ্যে।
--প্রণাম করবে না? বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করে কঙ্কন।
--কোনও মন্দিরে নয়, আমার ঈশ্বর জলে থাকেন, রিন রিন করে বেজে ওঠে বৃষ্টি। শিবাজি বলে, “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা না? ওফ্, অসাধারণ! এই মানুষটা নোবেল পাওয়ার যোগ্য। পেলেন না। হতভাগা দেশ।’’ বৃষ্টির মুখে মোনালিসা-হাসি। বেদনা-বিধুর।
--আসলে কী জানো শিবাজিদা, কোনও পুরস্কারই পরিষ্কার নয়। অনেক জল থাকে। তোমাদের ঈশ্বরও নিরপেক্ষ নন। বৃষ্টি ফের রিনরিনে।
--বড়ো ভাল বললে তো কথাটা! বিস্ময় বিপন্ন হয় শিবাজির।
--কঙ্কনদা, কালীপুজোয় আবার আসব এই পাহাড়ের দেশে, জঙ্গলে। মহেন্দ্র নিবাসের ছাদে তুবড়ি জ্বালবো। ফুলঝুরিও। সে বার কোনও ঈশ্বর-বন্দনা নয়। শুধু আতসবাজি। কালো আকাশটা রঙিন হবে। ঠিক আছে? বলে ওঠে বৃষ্টি।
--তথাস্তু। কথা দেয় কঙ্কন।
এ বার গাড়ি ছোটে কুলডিহা অরণ্যের দিকে। কুলডিহা অভয়ারণ্য। অজস্র হাতি। অরণ্যে আছে বাঘ-বাইসন-হরিণ-বিষাক্ত সাপ আর ভয়ঙ্কর দর্শন ভালুক। দাঁড়ালে ৬ ফুট। বাঘ-হাতিও এড়িয়ে চলে এখানকার ভালুকদের।
একটা চৌমাথায় গাড়ি দাঁড়াতেই নেমে পড়ে ছটফটে ববি, সঙ্গে সঙ্গে মিতা। মুহুর্তের মধ্যে তাদের গাড়িতে উঠতে বলে বহু-ঘোরা কঙ্কন, পথ যার বড়ো প্রিয়। চিত্কার করে কঙ্কন হলে, “এই ভুল করো না। এখানে গাড়ি থেকে নামা ভীষণ বিপজ্জনক। কখন কী হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না।” ত্রস্ত তারা তক্ষুনি গাড়িতে উঠে পড়ে। গাড়ি ‘মহেন্দ্র নিবাস’-এর পথ ধরে। দুপুরে দু’রকম মাছ, ঝিরঝিরে আলু ভাজা, সোনা মুগের ডাল, সুক্তো আর চাটনি। দুপুরে রিন্টুর একের পর এক জোকস। হাসির ফোয়ারা। বেলা গড়ায়। চা পানের পর কঙ্কনের গাড়ি ছোটে কুমকূট ড্যামের দিকে। ‘মহেন্দ্র নিবাস’ থেকে এই জলাধারের দূরত্ব মেরেকেটে চার কিলোমিটার। জলাধারের ধারে দাঁড়ালে গা ছমছম করে। কুলডিহার মতো ঘন না হলেও চারপাশের সবুজ গাছগাছালি যেন থম মেরে থাকে।
রাতে ‘মহেন্দ্র নিবাস’-এর ছাদের ওপর চাঁদ ওঠে। কঙ্কন আর বৃষ্টি। বাকি সবাই নীচে। সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা, আর বৃষ্টি যেন চন্দ্রিমা। রূপ-তাপস কঙ্কন তাকিয়ে দ্যাখে, একটা চাঁদ আকাশে হাসছে, আর একটা চাঁদ মাটির পৃথিবীতে। তার দশ হাত দূরে। এর পরও কি চন্দ্রাহত হবে না সক্ষম পুরুষ? হবে না পতঙ্গ-প্রাণ!
(যোগাযোগ-বারিকবাবু-মুঠো-ফোন:০৯৪৩৭৭৫৫১৮১)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy