“আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে
অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে—
—গঙ্গা আঁয়ে কহাঁ সে, গঙ্গা যায়েঁ কহা রে
লহরায় পানিমে জ্যায়সে ধুপছাঁই রে—”
নির্মলেন্দু চৌধুরী-হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জড়িমড়ি আসছে, তার ওপরে আবার রুনা লায়লাও দুলে উঠছে—“গঙ্গা আমার মা.....”। ভাতঘুম-ঘুম দশা। আচ্ছন্ন, বন্ধ চোখের দৃষ্টি যায় দূর-দূরান্তরে। স্বপ্ন-কল্পনা-বাস্তব সব মিলেমিশে একাকার। ফেলে-আসা নদ-নদীর সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের স্রোত মিশে যায়। মেঘনা-গঙ্গা-পদ্মা-যমুনা-কালা বদর কীর্তনখোলার জোয়ার-ভাটায় ছই-ওয়ালা বিশাল একখানা পাল তোলা গয়নার নৌকো নাকি, বজরা হেলতে-দুলতে এগিয়ে আসছে।
গলা ছেড়ে মাঝিমল্লারা ভাটিয়ালি গান গাইছে। জোয়ার-ভাটার টানে ঢেউয়ে ভর করে সেই গানেরা মহানন্দে ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শহর, শহরতলি বা গঞ্জের হাটে-বাজারে। অথচ, সেই উৎসের নৌকো হেলতে দুলতে আসছে বটে কিন্তু বহু দূরে.....।
পুরো সংসার-সন্তানেরা রয়েছেন সেই ছইয়ের মধ্যে। দুই ছেলে উঁকি দিয়ে দেখছেন— আর কত দূর? কৈলাস থেকে নেমে এসেছে সমতলের দিকে— জগৎজননী মা আমাদের নৌকোয় আসছেন এ বার।
“ঢং ঢং—”।
গেল চট্কা ভেঙে।
দেশের বাড়িতে আগেকার সেই “রাতের কড়া নাড়া” ছিল ভাল। এখানে, ফ্ল্যাটবাড়িতে ইলেকট্রিক বেল। সে নানান রকম বাজনা বাজে। পাখি ডাকে। অধমের বাসার “ঢং ঢং” এখন ক’দিন ধরে বিগড়েছে। ঢং ঢং-য়ের বদলে এখন এক বিচিত্র ধ্বনি বাজে। দু’চারটে কাক এবং একটি গাধার গলায় শ্লেষ্মা জমলে যে ভয়ানক আওয়াজ বেরোয়, সেই শব্দে রিং বাজে— ঢ্যাক-ঢংক্কা-ঢ্যাক।.....
ইজি চেয়ারে বেশ ঘুম ঘুম ভাব আয়েশে আচ্ছন্ন হয়ে, মনের তাজমহলে জোয়ার-ভাটায় দুলছিলুম ভাটিয়ালের টানের সঙ্গে সঙ্গে। কোত্থেকে এই মেঘলা আকাশের বিকেল হবো হবো সময়ে, অমন ভয়ংকর কর্কশ আওয়াজ করে কে এল?
দরজা খুলে দেখি মিশ্রাজি। আমাদের মুম্বইয়ের “মিষ্টান্ন ভাণ্ডার”। তাঁর পেছনেই অন্য দু’জন। পুরনো বন্ধুরা। মিশ্রাজির কথা পরে বলছি। তাঁর ধর্ম, কর্ম, পরিশ্রম আগে বলতে হয়। ভাটার টানে ভাটিয়ালির সঙ্গে সঙ্গে, নৌকোয় দুর্গামায়ের আগমন। দেশের মাটিতে পা পড়তে এখনও সময় রয়েছে বটে, তবে, যেমন কথায় বলে না, “লাখ কথার পর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়” তেমনই, বড় পুজো বা দুগর্তিনাশিনীর আরাধনায় যদি কয়েক লাখ খরচ না হয়, তাহলে, কীসের পুজো? তাও সর্বজনীন বা বারোয়ারি পুজো!
শুধুমাত্র ‘কথা’ খরচ হয় না। হয় লাখ লাখ টাকা খরচা। সেই খরচা তোলার দায়িত্ব পড়ে কমিটির ওপরে। সত্যাসত্যদের ওপরে। তার পরেই শুরু হয় জোগাড়-যন্তর। সেই শক্তিদার বিখ্যাত পদ্য :
“—রাতের কড়া নাড়া,—অবনী
বাড়ি আছো—”।
পুজো আসছে, চাঁদাটা দিয়ে
দাও। ভাই—!
আমাদের পাড়ার পুজোয় সে সব হ্যাপা নেই। সবচেয়ে বড় পুজো, গ্ল্যামারের চূড়ান্ত ইত্যাদি— রাতের কড়া-নাড়া নেই। কারণ, এ পুজোর হর্তা-কর্তা-বিধাতা অথবা অধিকারী মশাই, হলেন— ভ্রাতাসম গ্ল্যামারময়, ফিল্ম লাইনের বিখ্যাত গায়ক (একদা শব্দটা এখানে লাগসই হবে কি?)—অভিজিৎ। অভিজিৎ ভট্টাচার্য। এখানেও তথাকথিত পুজো কমিটি আছে। বিভাগ বিভাজন যথাযথ। তবে, কত্তা হলেন গিয়ে অভিজিৎ। মূল গায়েন সেই-ই। এক হাঁকে ডজন খানেক বা তার বেশি কর্পোরেট কোম্পানিরা মস্ত মস্ত স্টল দেবেন। স্যুভেনিরের পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ধন্য হবেন। আপন পাড়ায় পুজো হলেও কেমন যেন পর পর। একদিন যাই। গিয়ে মা’কে দর্শন করে, ‘দান-বাক্সে’ মায়ের নামে দরিদ্র ব্রাহ্মণের সাধ্যমতো দক্ষিণা দিয়ে— ভোগ খেয়ে আসি দুপুর বেলায়। ভোগের জন্য ভালই খরচা করে অভিজিৎ। এক কথায়, নামেই লোখান্ডওয়ালা সর্বজনীন, আদতে এটা অভিজিতের পুজো বলেই খ্যাত। বিশাল প্রতিমা, বিজনদার সেট, এলাহি আলো— সত্যি বড়ো পুজো। খাবারের স্টলে অনেক বাঙালি খাবার। দামও যথেষ্ট। এখানে সবই মহার্ঘ।
প্রতিবেশী পাড়া গোরেগাঁওতে (অথবা বাংলায় বলা যায়—‘ফর্সা গ্রাম’।) এ বার ফেনার পুজো। উৎপল দত্তের নাটকের বিজ্ঞাপন মনে পড়ছে—‘কল্লোল চলছে, চলবে।’ সাহিত্য জগতের ‘কল্লোল’ যুগ নয়। রীতিমতো এ বার জুবিলি। সুবর্ণ জয়ন্তী। অই ‘মুম্বই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। মিশ্রাজির সঙ্গে যে বন্ধুরা এল দু’জনেই ‘কল্লোল’-এর। সেক্রেটারি উৎপল চৌধুরী বহু কালের বন্ধু। সঙ্গে সভ্য জয়ন্ত। সাধারণত দেখা যায় প্রধান মাথা বা সম্পাদক, সেক্রেটারিরা দেখলেই মনে হয় ‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল’—অথচ উৎপল বেশ স্থির মস্তিষ্কে প্ল্যান করে কদম বাড়ায়। পঞ্চাশ বছরে পা পড়ার উৎসবে (ঘটনাচক্রে সেক্রেটারির সৎপুত্রের নামও ‘উৎসব’) খরচ হচ্ছে পৌনে কোটি থেকে কোটি খানেক।
পুজো মানেই উৎসব। ‘উৎসব’ বললে (বিশেষত বঙ্গ সন্তানদের) ইজ ইকোয়াল টু খাওয়া-দাওয়া। মিশ্রাজির দর্শন মাত্র মাথায় ঘোরে নানান খাদ্য-খাবার। তাই বোধন করলুম, “উৎপল, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কী কী হচ্ছে?” জবাব শুনে জিভে জল সড়াৎ সড়াৎ!
“পুজোর প্রসাদ, পাঁচ ছয় রকমের কাটা ফল-মথুরা প্যাড়া—”।
“আহা— সে সব তো আছেই। দুপুরে ঢালাও ভোজ ছাড়া—”।
আর, জানা গেল পাইকিরি হারে খাবারদাবারের স্টল। যেমন, হ্যাংলা ভিমা রোল, ফুড ফার্স্ট, কলকাতা কানেকশন—মিঠাইমণ্ডা-চপ-কাটলেট-কচুরি-সিঙারার মেলা। তার ওপরে দুপুরের ভোজ। সারা বছর দুর্ভোগের পরে চার-চার দিন ‘মায়ের ভোগ’। তাও আবার ‘সোনার’ চালের খিচুড়ির স্বর্ণ মুসুরি নয়, একেবারে ‘গোবিন্দভোগ’ চালের ভোগ! পশ্চিমবঙ্গ থেকে সোজা ‘ফর্সাগ্রামে’র কল্লোলে। মায়ের নৌকো যত এগিয়ে আসছে, বাংলা-ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে ভুর ভুর গন্ধ গোবিন্দভোগের। পারলে, ভক্তগণ পাঞ্জাবির সাইড পকেটে বা জননীরা আঁচলে বেঁধে আনতে পারেন— আসল গাওয়া ঘি গোবিন্দভোগের খিচুড়িতে দু’চার ফোঁটা পড়লে— আহা! এখনই সুগন্ধে ভুরভুর। ম ম করবে কল্লোলের পুজোবাড়ি। বারো হাজার লোককে খাওয়াবেন ও সন্ধেবেলা শোনাবের বাপি লাহিড়ি, উষা উত্থুপ, ক্যাকটাস বা ইন্দ্রাণী দত্তের ব্যালে নৃত্য ইত্যাদি।
১৬ ফুট উচ্চতার প্রতিমা, বানাচ্ছেন নিবারণ পালের ছোট ছেলে বিশ্বনাথ। লোখাণ্ডওয়ালার উত্তরে যেমন কল্লোল, তেমনই দক্ষিণে অধমের পুরনো পাড়া— বান্দ্রা। মানেই “নতুন পল্লি”। বিয়াল্লিশ বছর ধরে এই পুজো মুম্বইতে বিখ্যাত। পাঁচ মাথা বা (‘মাতালে’র)-র এই পুজোর এক ধুরন্ধর অধম। পুরনো মাথাদের মধ্যে এখনও সমান উদ্যোগে মাথা উঁচিয়ে আছেন ভোগ বা ভোগের দায়িত্বে থাকা শংকর মৈত্র। উনি বড় যত্ন করে আমাদের পেট পুরে খাওয়ান— খিচুড়ি, লাবড়া-পায়েস-পান্তুয়া। তা ছাড়া, প্রাচীন মাথাদের মধ্যে বন্ধুরা— বাসু চ্যাটার্জি, মণীশ ব্যানার্জি, গোপা-দীপক প্রমুখ। পুজোয় যত ফুল আসে চক্কোত্তির বাড়ি থেকে। একই পাল বংশের বড় ছেলে শিবদাস— এখানকার ১৫ ফুট উঁচু প্রতিমা গড়ছেন। এ বার আসল খাওয়া-দাওয়ার রাঁধুনি হলেন মেদিনীপুরের গোবিন্দ মল্লিক। ইনি আছেন তিরিশ বছরেরও বেশি। গোবিন্দর সুতো ধরে আবার মনে এল মণ্ডা-মিঠাই-সিঙাড়া-কচুরি-চপ। এবং প্রসঙ্গত, কান টানলে মাথা আসার মতো মিশ্রাজি এসে পড়েন।
প্রথম দেখেছিলুম মিশ্রাজিকে সেই গত শতকের শেষ দিকে। গোরেগাঁওয়ের ফিল্মসিটিতে। শু্যটিং ছিল দাদামণি মানে অশোককুমারের প্রথম সিরিয়ালের। দূরদর্শনের জন্য পরিচালক ঋষিকেশ মুখার্জিরও প্রথম ধারাবাহিক। “হাম হিন্দুস্তানী”। খুদে চরিত্রে মুখে রং মাখতে হয়েছিল। একটি বাঙালি চরিত্রে। ফার্স্ট শিফটে শু্যটিং। সকাল সাতটা থেকে দুটো তিনটে। দশটার মধ্যে ক’টা শট হয়ে গেল। ঋষিদা ঘোষণা করলেন, “টি-ব্রেক”। বলে দাদামণির সঙ্গে দৃশ্য আলোচনায় বসলেন।
তখন ঠিক চায়ের আগে, মানে, মোক্ষম সময়ে মিশ্রাজি এসে হাজির। সাদামাটা পোশাক। আমজনতার মতোই। ছাতা রঙের প্যান্ট। সাদা ফুল হাতা জামা। হাতা গোটানো নয়। রীতিমতো কবজিতে বোতাম লাগানো। তা ছাড়া, প্রথম প্রথম তো, ওর পোশাকের দিকে অত খুটিয়ে দেখিনি। কারণ, মিশ্রাজি বা ওর পোশাক তো মুখ্য নয় আমার কাছে। গৌণ। মুখ্য হচ্ছে ওর কাঁধের বোচকাটি। দেশের মধ্যে হলেও, পুবের সেই বাংলা-বিহার-ওড়িশার প্রান্ত থেকে ছয় হাজার কিমি দূরের এই সমুদ্র-ঘেঁষা পশ্চিমের বিভুঁই মুম্বইতে খাঁটি বাঙালির ঐতিহ্যময় “রসগোল্লা”, আলু-কড়াইশুঁটির সিঙাড়া কোথায় পাব? বিশেষ করে হাতের কাছে, মুখের সামনে। শহরের বিভিন্ন মুলুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু’চারটে দোকান থাকলেও তা দূরে দূরে। উজিয়ে যেতে হয়। উদ্যোগ-আয়োজন করতে হয়। তার চেয়ে যে যেখানে আছেন, তাঁদের চোখের সামনে হাজির হলে মন্দ কি!
টি-ব্রেকে প্রায় সকলেই এসে হাজির হলেন লোলার টানে। মোবাইল মিষ্টির দোকান খুলতে লাগলেন মিশ্রাজি। স্টুডিওর ফ্লোরে উবু হয়ে বসে।
পরিষ্কার মোটা কাপড়ের পুঁটলি। যেন ছোটখাটো কচি একটি পিরামিড কাপড়ে ঢাকা চূড়োয় গিঁট বাধা। অনেকটা পাতলা চুলওয়ালা মহিলারা যেমন চুলের গিট মেরে দেন, তেমনই কাঁধার উঁচু অ্যালুমিনিয়ামের থালা নামল চূড়া থেকে। ঢাকনা খুলে রাখল মিশ্রাজি। এমনই ছোট থেকে বড়, তার থেকে বড়— এমনই একের পর এক মোট চার পাঁচটি সাজিয়ে রাখল সে। মানে হল, ছোট ডেকচির ওপর থেকে পিরামিডের স্তর ভেঙে স্টুডিওর ফ্লোরে গোল করে সাজিয়ে রাখা— রসের পুকুরে সাদা রসালো রসগোল্লা তৈরি। ল্যাংরা, কমলাভোগ, চমচম মায় লবঙ্গলতিকা পর্যন্ত। সঙ্গে একটি মাঝারি থালায় দুই ভাগে কড়াইশুঁটির গরম সিঙারা, নিমকি। মিষ্টি খেতে খেতে মুখ বদলের ব্যবস্থা।
সে দিন বেশির ভাগ মিষ্টি, নোনতাই উড়ে গিয়েছিল। সব কিছু যথেষ্ট স্বাদু বলা যায়। ময়রার প্রশংসা করতেই হয়। প্রথম দিন আলাপ হয়েছিল শুধু। আট দিনের শু্যটিংয়েই মিশ্রাজির সঙ্গে দেখা হয়েছিল কয়েক বার। জিজ্ঞেস করেছিলুম একবার, ‘‘শুধু স্টুডিওতেই ঘোরেন, না পাড়াতেও খদ্দের আছে?”
মানুষটি এমনিতে বেশ গম্ভীর গম্ভীর। একটু আধটু হাসি কোনও অসতর্ক মুহূর্তে দেখা যায়। থালা, বাটি, ডেকচি একটির পর একটি সাইজ মতো রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিশ্রাজি। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই জবাব দিলেন , “যাই। কয়েকটা পাড়ায়। আন্ধেরির লোখণ্ডওয়ালায় ছয় সাতটা বাড়িতে। সাতবাংলায় ও চেম্বুরের বাঙালি পাড়ায়।”
“রোজ”? অবাক হলুম! কারণ, একেবারে বিপরীত দিকে চেম্বুর।
“না। সপ্তাহে ছয় দিন ভাগ করা আছে। এক একদিন একেক পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে।”
লোখণ্ডওয়ালায় আপন বাসাবাড়ির ঠিকানা দিয়ে রাখলুম। ও দেখে বললে, “আপনাদের পাড়ায় অমুক অমুক বাড়ির কয়কটি ফ্ল্যাটে প্রতি বুধবার যাই। নমস্তে—” বলে ছোট্ট মিনি ‘পিরামিড’ কাপড়ে জড়িয়ে কাঁধে চালিয়ে এক হাতে ধরে হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। অন্য স্টুডিওর উদ্দেশ্যে। ‘ফিল্মিস্তানে’ বলে গেল।
মানুষটির আচার-আচরণ দেখে আমার সম্বোধনে কখনও ‘তুমি’ আসছে, কখনও ‘আপনি’। কারণ স্রেফ ফিরিুওয়ালা স্তরের মানুষকে চট করে ‘আপনি’, ‘আজ্ঞে’ করতে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের কেমন বাধো বাধো ঠেকে। প্রথম দিন ‘আপ’, ‘তুম’ গুলিয়ে কথা বলেছি স্টুডিওর অন্য খদ্দেরদের দেখাদেখি। কিন্তু পরের সপ্তাহে বুধবার যখন দরজার বেল শুনে খুলে দেখলুম মূর্তিমান ‘মিষ্টির দোকান’ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে— বেশ একটু অবাকই হয়েছিলুম। এবং যে ভাবে ‘নমস্তে’ বললেন, শুনে, যথেষ্ট আপ্যায়নের সঙ্গে বললুম, “আইয়ে মিশ্রাজি। ভেতরে আসুন।”
অথচ কাঁধের উক্ত কাপড়ে জড়ানো ‘মিনি পিরামিড’টির জন্যেই কিনা জানি না, সোফায় বসতে আহ্বান করতে পারলুম না। উনি নিজেই কিছু বলার আগে ড্রইং রুমের পরিষ্কার মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে, দ্রুত অভ্যাসের হাতে পিরামিডের থর ভেঙে ভেহে যথারীতি মেঝেতে শো-রুম সাজিয়ে ফেললেন। কোনও আলাপ-চারিতার মধ্যেই নেই। সরাসরি সামগ্রী বিক্রির পথ ধরলেন, নিঃশব্দে।
সাধারণ রসগোল্লার চেয়ে একটু ছোট সাইজের। দাম চার টাকা। যাই নাও চার টাকা। দুটো চারটে করে প্রায় সবই রেখে দিলুম প্রথম দিন। যাতে উনি প্রতি বুধবার আসেন। হোলও তাই। এখনও বুধবার এগারোটা নাগাদ সকালে এসে পড়েন মিশ্রাজি। ধরেছিলুম ক’দিন। কথাবার্তার জন্যে।
বউ, তিনটি মেয়ের সংসার এখানেই। তোম্বিভিলিতে। কলকাতা-মুম্বইয়্রে সব ট্রেনই যে জংশন স্টেশনে দাঁড়ায়। সেই কল্যাণের পরের স্টেশন ‘তোম্বিভলি”। প্রায় ডজন খানেক ফেরিওয়ালা বাঁধা আছে কল্যাণের বিখ্যাত ‘মোতি ময়রার’ দোকানের সঙ্গে। রোজ সকালে সামগ্রী সব তুলে ফিরি করতে বেরোন সবাই। যেমন মিশ্রাজি। সারা দিনের বিক্রিবাটা থেকে কমিশন রেখে বাকি রোজগার ময়রাকে ফেরত দেন। এই করেই সংসার চলে আসছে তিরিশ বছর।
পুরো নাম রামশরণ মিশ্রা। মেয়েদের নাম জিজ্ঞেস করলুম।
“বড়ি কমলা, মাঝলি শ্যামলা, ছোটিকে ছোটি বলেই ডাকি। স্কুলের নাম অসলা। বড়ির সাদি দিয়ে দিয়েছি। তখন পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে মুলুকে গিয়েছিলুম। তারপর, শ্যামলা বি-কম পরীক্ষা দেবে এ বছর।” গেল বছর দেখা হল ‘আরাধনা’র ডাবিং স্টুডিওয়। অবিশ্যি বুধবারগুলো একবার আমার দরজায় দেখা করে যাচ্ছেন মিশ্রাজি—
“কুচ চাহিয়ে”?
“না, আজ নয়।” বলে ফেরত পাঠাতে খারাপ লাগলেও নিত্য একই সামগ্রী রাখা হয় না।
তা, ‘আরাধনা’ স্টুডিওতে বিজ্ঞাপনের বাংলা তর্জমা করে ডাবিং করছিলুম। ওরই মধ্যে এক ফাঁকে দম নিতে বেরিয়ে দেখি মিশ্রাজির পিরামিডের থর থেকে এক এক করে বেরোচ্ছে— সিঙাড়া, লবঙ্গলতিকা ইত্যাদির সবশেষে তলায় বড় ডেকচিতে রসের ডোবায় ভাসছে সাদা রসগোল্লার দল।
ওর কেনাবেচার মধ্যেও জিজ্ঞেস করলুম , “আপনার মাঝলি বেটি শ্যামলার পরীক্ষা হয়ে গেছে?”
কাজ থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বেশ উৎফুল্ল ভাবে, “বি-কম পাশ ভি হো গায়ে। এখন মিঠিবাই কলেজে কর্মাস শিখছে। ” হিসেব-নিকেষের সেক্রেটারির কাজ শিখছে। —সি এ—।”
কলাকুশলীদের ল্যাংচা চমচম দিতে দিতে বলল, “ওর বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে দাদা।”
“কবে? কোথায়?” উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলুম।
“দো সামোসা অউর দো উও মিঠা সামোসা”— সহকারী সাউন্ড রেকর্ডিস্টকে (এরা লবংগলতিকাকে এখানে ভাঁজের জন্যই হয়তো মিঠা সামোসা বলে) দিতে দিতে জবাব দিল মিশ্রাজি, দুর্লভ হাসি দিয়ে, “আপনার ঘরে আসব না? কার্ড দিতে? তখন দেখবেন। সামনের মাসে ...”
মনে মনে খুব আনন্দিত হলুম। কারণ, একটি মানুষ, যার নাম রামশরণ শর্মা, নিবাস তোম্বিভোলি, আদি নিবাস জিলা বারাণসী এবং এখানে স্রেফ ময়রার সামগ্রী ‘ফিরি’ করে সংসার চালায় এবং দ্বিতীয় কন্যাকে গ্র্যাজুয়েট বানিয়ে, তার বিবাহের ব্যবস্থাও করে ফেলেছে— স্রেফ কমিশনে জীবনযাপন। তাও মিষ্টি- নোনতার সামগ্রী ফিরি করে সামান্য কমিশনে।
পরের সপ্তাহে মঙ্গলবার এসে হাজির মিশ্রাজি। ‘পিরামিড’বিহীন। স্রেফ থলেতে একগাদা নেমন্তন্নের কার্ড। একটি আমাকে দিয়ে বললে, “কাল বুধবার আর আসব না। পনেরো দিনের জন্য ‘দেশে’ যাচ্ছি। মাঝ্লির বিয়ে সামনের বুধবার। মুলুকে।”
“ছেলে কী করে? বেনারসে থাকে?”
হেসে বললে, “ছেলে আমাদের গ্রামের। থাকে তোম্বিভেলিতে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।”
“আমি তো আপনাদের গ্রামে, অত দূর, এখন যেতে পারব না।”
“না, না। অত দূরে আসতে হবে না দাদা। কার্ডটি খুলে দেখুন। এখানকার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত, আত্মীয়স্বজনের জন্যে ছোট করে ‘রিসেপশন’ রেখেছি আমাদের বাসার উঠোনে। এখানে আসবেন কিন্তু।”
মিশ্রাজি আজকে মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে এসেছেন। ‘ফিরি’ করতে নয়। আপ্যায়নের ত্রুটি না থাকে, তাই বললুম, “একটু মিষ্টিমুখ করে যান।”
কট্টর বেনারসী ব্রাহ্মণ। জলস্পর্শ করবেন না। হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করবেন। বাইরে কিছুই খাওয়া বারণ আমাদের।”
মেয়ের বিয়ের রিসেপশনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে ছিল না, তা নয়। মিশ্রাজির ব্যাপারে কৌতূহল ছিলই। তবুও যাওয়া হয়নি। বেলাইনে অত দূর— সেই থানা জেলার তোম্বিভোলি।
মাস দেড়েক পরে দেখা হল মেহবুব স্টুডিয়োর প্রাঙ্গণে। তাঁর বাণিজ্যের ‘পিরামিড’ খুলে, থালা সাজিয়ে বসেছেন রামশরণ মিশ্রা। কেনাবেচা শেষ হলে আমার চেয়ারের কাছে এসে মাথা সামান্য নুইয়ে বললেন, “নমস্তে দাদা। আপনি তো আসতে পারলেন না। আশা করেছিলাম ...”
মৃদু হেসে ক্ষমা চেয়ে বললুম, “ছোট মেয়ের বিয়েতে যাবার কথা দিচ্ছি। কদ্দিন পর...”
“বাবা বিশ্বনাথ জানতে হ্যায়।”
দেখলুম চুল বেশ খানিকটা সাদা। বয়েস ষাট পেরিয়ে গেছে। চাকরিতে থাকলে রিটায়ার করে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা পেনশনের টাকায় বাকি জীবন... কিন্তু মিশ্রাজি?
“ব্যস! ছোট্কির বিয়ে পর্যন্ত। তারপর নিশ্চিন্ত মনে হরিদ্বার হৃষীকেশ চলে যাব। গিন্নিকে নিয়ে।”
‘পিরামিড’ ঘাড়ে তুললেন। কাঁধ একটু ঝুঁকে পড়েছে। আগের মতো হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন না। গতি শ্লথ হয়ে গেছে কি? হয়তো মনের ভুল। মনে হল একটা জীবন বিনামূল্যে ফুরোতে চলল? না কি তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে সার্থক জীবন?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy