দিনগুলো ছোট হতে হতে আবার ২৫শে ডিসেম্বর থেকে বড় হতে শুরু হয়, তাই কি এই দিনের নাম বড় দিন? তা হলে যে দিনটি বছরের সব থেকে বড় সে দিনটিকে কি বলা হবে? এমন কি হতে পারে না ওই দিনটিতে মহপুরুষ যিশু জন্মেছিলেন তাই এটি বড় অর্থাত্ মহান দিন?
থেরেসার এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় নেই। খুবই ব্যস্ত ক্রিসমাসের প্রস্তুতি নিয়ে। থেরেসা একজন রোমান ক্যাথলিক। থাকেন মাঝগাঁওতে। বড় দিনের আগে সুদৃশ্য মোমবাতি তৈরি করেন।
মাঝগাঁও-বাইকুল্লা এলাকাটিতে বৃটিশদের আসার সঙ্গে সঙ্গে বহু ক্যাথলিক খৃস্ট ধর্মাবলম্বীর আগমন ঘটে। তবে প্রটেস্টান্ট খৃস্টানরাও আছেন এখানে। তাদের পৃথক গির্জাও আছে। আর মাত্র তিন দিন বাদেই সেই মহান পুরুষের জন্ম দিন। শীতের হিমেল বাতাস তারই বার্তা বহন করছে। মুম্বইতে খৃস্টান মহলে এই উত্সব পালনের প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়।
আপাত দৃষ্টিতে আধুনিক এই মুম্বই শহরটাতে একটু অতীতের পাতাগুলো ওলটালে পাতার আনাচে কানাচে এই শহরের ইতিহাসের অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়। আর বিশেষ করে মুম্বইএর গির্জাগুলোর পাথরের খন্ডগুলোর খাঁজে খাঁজে তার ইতিহাস ধরা রয়েছে। যেমন কোলাবার আফগান গির্জা, মাহিমের সেন্ট মাইকেল গির্জা, বান্দ্রার মাউন্ট মেরি গির্জা--- প্রত্যেকটিরই একটি চমকপ্রদ পটভূমি আছে। এই সব ইতিহাসখ্যাত গির্জাগুলোর পটভূমি আমরা জানি। কিন্তু বাইকুল্লার গ্লোরিয়া গির্জার ইতিহাস পর্তুগিজ আমলের, আর তা বোধহয় আমাদের জানা নেই।
আজকের গ্লোরিয়া গির্জা তার বিশাল আকার নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটি তার আদি জায়গা নয়। প্রথমে তার এই বিশাল আকার ছিল না। ১৫২৯ খৃস্টাব্দ নাগাদ মাহিম ও বম্বে অঞ্চল দুটি ফোর্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই অঞ্চলটিকে জিতে নেন লোপো ভাজ ডি সামপিও এবং এই অঞ্চলের গভর্নর হন ১৫২৯ খৃস্টাব্দে। এরপর ভাইসরয় ডম জাও ডি কাস্ত্রো অঞ্চলটিকে ছোট ছোট জমিদারিতে বিভক্ত করেন। এবং এই ছোট ছোট জমিদারিগুলো ভাইসরয় তাঁর যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করে দেন। এই যোদ্ধাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন এন্টোনিও পেসোয়া যেমন বীর ছিলেন তেমনই ভালো শাসক ছিলেন। ভাইসরয় ক্যাপ্টেন এন্টোনিও পেসোয়াকে মাঝগাঁও, বান্দ্রা ও খার-- এই তিনটি এলাকা দেন ১৫৪৮ খৃস্টাব্দে। এন্টোনিও এই তিনটি গ্রামের মধ্যে মাঝগাঁও, বান্দ্রা ও খারের অপরিচিত জায়গার বদলে কোনও পরিচিত অঞ্চলে থাকার সিদ্ধিন্ত নেন। কিন্তু ধান চাষ ও মাছের ভেরির কারবারের জন্য তার ম্যানর হাউস মাঝগাঁওতে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।
ব্যক্তিগত উপাসনার জন্য এই ম্যানর হাউসের লাগোয়া নোসা. সেনহোরা. ডা গ্লোরিয়ার নামে একটি ছোট চ্যাপেল তৈরি করান। এই চ্যাপেলটি ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার হদিস পাওয়া যায় না। কিন্তু ধরে নেওয়া হয় যে ১৫৪৯ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে চ্যাপেলটি প্রস্তুত হয়েছিল। ধীরে ধীরে এটি পর্তুগিজ মিশন চার্চের অন্তর্গত গির্জায় পরিণত হয়। ১৫৭১ খৃস্টাব্দে এন্টোনিও মারা গেলে গির্জাটি লিওনেল ডি সুজাকে লিজ দেওয়া হয়। লিওনেল সম্পর্কে ছিলেন এন্টোনিওর জামাই। এরপর মাঝগাঁওতে ক্রমাগত লোক বাড়তে শুরু করল। প্রয়োজন হল বড় একটা গির্জার। লিওনেল এর বিধবা স্ত্রী চ্যাপেলটিকে একটা বড় গির্জা তৈরি করার অনুমতি দেন। ১৫৯৬ খৃস্টাব্দে চ্যাপেলের জায়গায় একটা গির্জা তৈরি হয়। এবং তার দায় দায়িত্ব ১৬৩২ খৃস্টাব্দে বর্তায় লিওনেল-এর পুত্র রুইএ ডি সুজার উপরে। এরপর ১৬৬০ থেকে ১৬৭১ খৃস্টাব্দের মধ্যে খৃস্টোভো ডি সুজা টাভোরার তত্ত্বাবধানে গির্জাটি আরও বড় হয়।
মাঝগাঁও-এর এই গির্জাটি যদিও ফ্রান্সিসকান নয় তবুও ফ্রান্সিসকানরাই এই গির্জাটির তত্ত্বাবধান করত ১৭২০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৮১০ সালে পুরনো গির্জাটিকে খারাপ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে পুনরায় নির্মাণ করা হয়। ১ অক্টোবর ১৮১১ তে জনগণের জন্য গির্জাটি আবার খুলে দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন এন্টোনিওর শেষ দলিলে গির্জাটি রক্ষণাবেক্ষণের কথা লেখা ছিল। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আওতায় মাঝগাঁও আসার পর এন্টোনিওর শেষ ইচ্ছাকে মনে রাখার চেষ্টা করা হয়। কোম্পানি গির্জাটিকে বছরে পনেরোশো টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুশো চল্লিশ টাকা দিতে থাকে। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বহুবার মেরামত হয়। ১৮৯২ সালে গির্জাটিকে রং করা হয়।
সালটা তখন ১৯০৮। গির্জাটির বোর্ডের সভাপতি রেভারেণ্ড এল. সি. পেরা গির্জার ওয়ার্ডেনকে খবর দেন যে সরকারি গেজেটে ১৬ই ফেব্রুয়ারি একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে যে জনসাধারণের কাজের জন্য বর্তমানে যে অঞ্চলটিতে গির্জাটি রয়েছে সেই এলাকাটি এবং তার লাগোয়া ম্যানর হাউসের জমিটি দখল করা হবে। কারণ জমিটি বম্বে পোর্ট ট্রাস্ট রেলের অন্তর্গত। শেষ পর্যন্ত দু’লাখ টাকার বিনিময়ে গির্জা কর্তৃপক্ষ জমিটি ছেড়ে দেয় এবং আজ যেখানে গ্লোরিয়া গির্জাটি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে সরে আসে। ক্যাপ্টেন এন্টোনিওর নামে নতুন গির্জার লাগোয়া এন্টোনিও ডি সুজা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯২৫ খৃস্টাব্দে যা আজও বর্তমান। পুরনো জায়গাটিতে স্মৃতি হিসাবে একটা ক্রস পুঁতে দেওয়া হয়।
থেরেসার বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখা গেল বড় একটা সুদৃশ্য তারা ঝুলছে। যিশুর আগমন বার্তা ঘোষণা করার জন্য এই তারাটিই যথেষ্ট। পুরোনো আমলের একতলা বাংলো বাড়ি থেরেসার। বারান্দায় নানা আকারের এই মোমবাতিগুলো ছোট থেকে বড় আকারে সাজানো রয়েছে। থেরেসা এই মোমবাতিগুলো পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন উপহারের দোকানে। দিনে ছোট মোমবাতি চল্লিশটা বানাতে পারেন। দাম পঞ্চাশ থেকে পাঁচশো টাকা পর্যন্ত। অনেক দিনের এই ব্যবসা থেরেসার। তাই কথার মাঝখানে মাঝেমধ্যেই মানুষজন আসছে মোমবাতি কিনতে। মুম্বই-এর গির্জাগুলোর সামনের চত্ত্বরে অনেক মোমবাতি বিক্রি হয়। কিন্তু থেরেসার কাজ শৌখিন তাই এগুলি একটু বেশি দামে উপহারের দোকানে চলে আসে। মোমবাতির পাশাপাশি ক্রিসমাস ট্রিও তৈরি করেন এঁরা। এই ব্যবসাটি থেরেসার স্বামী রবার্টের। দাম তিনশো টাকা থেকে শুরু এই ক্রিসমাস ট্রিগুলোর। এগুলো রবার্ট ভাসাই-এর দিকের গির্জাগুলোতে বিক্রির জন্য দিয়ে আসেন।
রেশমি ডুং ডুং জামশেদপুরের মেয়ে। থাকেন এখানে কুর্লাতে। শখে চকোলেট তৈরি করা শিখেছিলেন। এখন চকোলেট তৈরি করে বিক্রি করেন। রেশমি কী ভাবে এই ব্যবসাটি চালাচ্ছেন? এ যুগের মেয়ে রেশমি। তাই ফেসবুক তার প্রচার মাধ্যম। রেশমি বললেন, চকোলেটের চাহিদাটা শুরু হয় ক্রিসমাস থেকে। থাকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পর্যন্ত। বিশেষ চকোলেট হিসাবে রেশমি ওয়াইন চকোলেটও বানান। তবে সেটি অর্ডারের উপর নির্ভর করে।
ফোর্টের কাছে মুম্বই-এর বড় বড় উপহারের দোকানগুলো ক্রিসমাসের সাজে সেজে ফেলেছে। বম্বে স্টোরের বাইরের দিকের উইন্ডোতে সান্টাক্লজ স্লেজ গাড়িতে চড়ে উপহার নিয়ে আসছে। কাশ্মীর এম্পোরিয়ামে ক্রিসমাস ট্রিতে ঝোলানোর জন্য রং বেরঙের পেপার ম্যাশের তৈরি ছোট ছোট তারা আর বল এসে গেছে। পশরা এসে গেছে কন্টেম্পোরারি আর্টেও। এখানে ঘরে সাজানোর জিনিসগুলো ক্রিসমাসকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। মুম্বই-এর ক্রফোর্ড মার্কেট অনেকটা কলকাতার নিউ মার্কেটের মত। চকোলেট, লজেন্স রঙীন কাগজের টুপি, ছোট বড় নানা মাপের উসবের টুপি, ক্রিসমাস ট্রি অনেক দিন থেকে বিক্রি হচ্ছে এখানে। সান্টাক্রুজ, কোলাবা, মাহিম গির্জা, বান্দ্রার মাউন্ট মেরী গির্জার সামনে বড়দিনের ঘর সাজানোর জিনিস উপচে পড়ছে। এছাড়াও বান্দ্রা হিল রোড, লিংকিং রোড ইত্যাদি জায়গাতেও বসে গেছে ক্রিসমাসের পসরা।
এতো গেল নানা রকম উপহারের দোকানের কথা। কিন্তু ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটস্ আপের যুগে বড়দিন, নতুন বছরের শুভেচ্ছা পত্রের বিক্রি কেমন? শুভেচ্ছা পত্রের দোকান আর্চিস-এর প্রতিনিধি বলছেন তারা ব্যবসাটাকে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের উপহারও নিয়ে এসেছেন। এগুলির মধ্যে নানা ধরনের সফ্ট টয়েজ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ক্রিসমাসকে লক্ষ্য করা উপহার। তবে আর্চিসে পুরনো মানুষদের ভিড় হয় কার্ড কেনার জন্য যাদের মন ভরে না এই সব আধুনিক যুগের শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে। সান্টাক্লজ কার্ড, স্নো কার্ড, ক্রিসমাস ট্রি কার্ড, শুধু আর্চিস কেন সাধারণ কার্ডের দোকানগুলোতে ভরে গেছে।
ক্রিসমাসের প্রস্তুতিতে মুম্বই-এর হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোও পিছিয়ে নেই। এবছর মালাড পশ্চিমের ওরলেম-এ ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় পার্টি শুরু হবে রাত ন’টা থেকে। লীলাবতী হাসপাতালের কাছে বাংলো নাইনে উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ডের ক্রিসমাস বল শুরু হবে ২৫শে ডিসেম্বর সন্ধ্যে সাড়ে আট’টার সময়। আন্ধেরি পূর্বের হোলি স্পিরিট অডিটোরিয়ামে ২৫ শে ডিসেম্বর সকাল দশটার সময় শুরু হবে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘জেসাস ফর অল নেশনস্’। ওয়েস্টার্ন হাইওয়ের ওবেরয় মলে বেলা চারটের পর ক্যারল গান ও ক্রিসমাস প্যারেড হয়ে থাকে। হোটেল মেরিন প্লাজা, মেরিন ড্রাইভে সান্টাক্লজের সঙ্গে ক্রিসমাস ফিয়েস্তা হয়ে থাকে ২৪ এবং ২৫ শে ডিসেম্বর। ইন্ডিয়া বুল সেন্টারের এফ লাউঞ্জ ডিনার এন্ড বারে ২৪ শে ডিসেম্বর তার দশটার পর রেড হট ক্রিসমাস পার্টি নাইট রাখা হয়। বান্দ্রা পশ্চিমের লিংকিং রোডের কাছে এসকোবারে হোয়াইট পার্টি হবে। আউট অফ দ্য ব্লু গত বছরেও ক্রিসমাস মিডনাইট বুফে রেখেছিল ২৪ তারিখ এবং ২৫ তারিখ ক্রিসমাস লাঞ্চ বুফে রেখেছিল। এ বারেও কিছু বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে।
ভাসাইএর খৃস্টান অধ্যুষিত পাড়াগুলোতে বাড়ির বাগানের মধ্যে প্রভু যিশুর আগমন বৃত্তান্ত পুতুল দিয়ে সাজানো শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছু দিন হল। স্থানীয় গির্জার থেকে এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সজ্জাটিকে পুরস্কৃত করা হয়। চারিদিকে আয়োজন প্রায় শেষ। এখন শুধু তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy