বিশ্বজিৎ ও শ্রাবন্তীর চার হাত এক হল জুমেই। —নিজস্ব চিত্র।
মালাবদল হল না। সিঁদুরদানও নেই। কিন্তু এই লকডাউনে বিয়ে সেরে ফেললেন মধ্যমগ্রামের বিশ্বজিৎ রায় আর বনগাঁর শ্রাবন্তী মজুমদার। কী ভাবে এটা সম্ভব হল? আসলে, পুরো বিয়েটাই হল জুমে। কর্মসূত্রে বিশ্বজিৎ এখন গুরুগ্রামে এক বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। লকডাউনে বাড়ি আসতে পারেননি বিশ্বজিৎ।
তাতে কী?
বিশ্বজিতের বাবা পুরোহিত নিয়ে মধ্যমগ্রামের বাড়িতেই সারা দিন না খেয়ে রাত সওয়া ৮টার শুভ লগ্নে ছেলের বিয়ে দিতে বসেছিলেন গত ২৫ বৈশাখ। অন্য দিকে হবু বরের পছন্দের লাল-হলদেটে ঢাকাই শাড়ি পরে বনগাঁ থেকে মা আর দাদাকে পাশে নিয়ে বসেছিলেন শ্রাবন্তী। আর গুরুগ্রামে একা নেহাতই একটা স্যান্ডো গেঞ্জি চড়িয়ে টোপর ছাড়াই বিয়ে করতে বসেছিলেন বিশ্বজিৎ। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হল। বর আর বউ বুকে হাত দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, ‘‘যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম...”
না, এ ভাবে যে বিয়ে করতে হবে তা বিশ্বজিৎ বা শ্রাবন্তী কেউই ভাবেননি। “আমরা দু’জনেই আনন্দবাজারের কাছে কৃতজ্ঞ। পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ। তবে আমাদের যে দিন প্রথম দেখা হয়, আমার বিশ্বজিৎকে দেখে তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু যে মুহূর্তে ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ আর রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলতে শুরু করল আমার ভেতরটা কেমন গুলিয়ে গেল!”
আরও পড়ুন: নাকু লা-য় সংঘর্ষের আগেই লাদাখে আকাশসীমা লঙ্ঘন চিনা কপ্টারের
কনের বেশে শ্রাবন্তী মজুমদার। —নিজস্ব চিত্র।
এই গান আর কাব্যচর্চা দিয়েই ডিসেম্বরের শীতে বসন্ত নামিয়ে আনেন শ্রাবন্তী আর বিশ্বজিৎ! ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’। দু’জনেই ঠিক করেন বিয়ে করলে পঁচিশে বৈশাখই করবেন, নয়তো নয়। “আমাদের দু’জনের কথা মানেই রবীন্দ্রনাথের গান। আমি রবীন্দ্রভারতীতে বাংলা নিয়ে পিএইচডি করছি। আমিও এর মধ্যেই ডুবে থাকি! আমাদের সব কিছুতে রবীন্দ্রনাথ। পঁচিশে বৈশাখ ছাড়া আমাদের বিয়ে অন্য দিন হতে পারত না!” জোর গলায় বললেন শ্রাবন্তী।
ছাপা হয়ে গেল বিয়ের কার্ড। সেই কার্ডেও রবীন্দ্রনাথের লাইন। এক দিনের জন্য কলকাতায় এসে দুম করে আংটি পরিয়ে দিলেন বিশ্বজিৎ, তাঁর বাগদত্তাকে। কেনা হয়ে গেল বিশ্বজিতের বাড়ির তরফের বেনারসি শাড়ি। বিশ্বজিতের বাড়ি থেকে মধ্যমগ্রামে বিয়েবাড়িও বুক করে ফেলা হয়। অন্য দিকে শ্রাবন্তীর বাড়িতেই বিয়ের তোড়জোড়, গয়না, খাবারের মেনু ঠিক হতে থাকল। এর মাঝেই লকডাউন! জমায়েতে যত বন্ধন।
তা হলে কি বিয়ে ভেঙে দিতে হবে?
“আমি তো ভেবেছিলাম যা হয় হোক, গাড়ি নিয়ে কলকাতা যাব! এত দিনের প্ল্যান! আমাদের বিয়ে হবে না? খুব আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম। এখনও তো বাড়ি বুকিংয়ের টাকা ফেরত পাইনি। শেষে ভাবলাম সব কাজ এখন টেকনোলজির মাধ্যমে হচ্ছে, বিয়ে কেন হবে না?” সাফ কথা বিশ্বজিতের। যেমন কথা তেমনই কাজ। শ্রাবন্তীর বাড়ি থেকেও সকলে রাজি! অফিসের কাজ নয়। এ বার জুমেই বিয়ে হল পঁচিশে বৈশাখ।
অন্য দিকে শ্রাবন্তীকে আগেই জুমের লিঙ্ক পাঠিয়ে রেখেছিলেন তাঁর হবু স্বামী। “প্রথমে ভেবেছিলাম জীবনের এমন একটা কাজ শেষে জুমে করতে হবে? পরে মন বদলাই বিশ্বজিতের ইচ্ছেতেই। জুমে বিয়ে করতে রাজি হই। ওর খুব ইচ্ছে ছিল লাল আর হলদে পাড়ের শাড়ি পরে ওর সামনে আসি। বাড়িতে ওই রকম একটা নতুন শাড়িই ছিল, সেটা পরেই বসলাম”, উত্তেজিত শ্রাবন্তী।
সকালে শ্রাবন্তীর বনগাঁর বাড়িতে নারায়ণ পুজো হয়েছিল। “আর আমি উপোস করেই ছিলাম। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নিরামিষ খাই”, যোগ করলেন শ্রাবন্তী। আশি মিনিটের জুমের ভিডিয়ো রেকর্ডিং এখন তাঁদের বিয়ের একমাত্র সম্বল!
গুরুগ্রাম থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বিশ্বজিৎ বললেন, “আমি টেকনোলজির লোক। আমার কাছে ডেডলাইন সবচেয়ে আগে। জীবনের এই ডেডলাইন করোনার জন্য কোনও ভাবেই মিস করতে চাইনি আমরা। যুগ এগিয়ে যাচ্ছে, বর দেরিতে পৌঁছল বলে মেয়ে লগ্নভ্রষ্ট হল সে সব দিন চলে গিয়েছে। আমাদের বিয়ের খবর পড়ে নিশ্চয় আরও মানুষ এ ভাবে বিয়ে করবেন বলে আমার বিশ্বাস!”
অগ্নিসাক্ষী বা বাসি বিয়ের কাজ যদিও বাকি রেখেছেন শ্রাবন্তী-বিশ্বজিৎ। “সামনে না এলে সিঁদুর পরা সম্ভব নয়। ওটা এখন থাক। তবে আমরা বিয়ের পরের দিন কালরাত্রি মেনে এক বারও কেউ কাউকে হোয়াটসঅ্যাপ কল করিনি”, বললেন শ্রাবন্তী।
আরও পড়ুন: ভারতে ফ্যাভিপিরাভির ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করোনা রোগীদের উপর
আর ফুলশয্যা?
প্রচন্ড হেসে শ্রাবন্তী জানালেন, “ওটা শুধু হোয়াটসঅ্যাপ কলেই বন্দি ছিল।” বাড়ির লোকজন, শাশুড়ি ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, বিবাহিত মেয়েদের হাত খালি রাখতে নেই।
এই করোনা ঘেরা বিশ্বে পর পর অনেক কিছু হয়ে চলেছে শ্রাবন্তী-বিশ্বজিতের জীবনে। বিয়ে বাতিলের সিদ্ধান্ত, জুমের মতো অভিনব ছাদনাতলায় বিয়ে। রবীন্দ্রভারতীর জন্য অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন শ্রাবন্তী, আর বিশ্বজিৎ ওয়ার্ক ফ্রম হোম।
শ্রাবন্তী বলে চলেন, “বিয়ের পর দিন থেকেই বড্ড মন কেমন করছে আমাদের। শুধু এ ভাবে দেখে দেখে... আর যেন পারছি না। সারা ক্ষণ মনে হচ্ছে, এখন ও কী করছে? ঠিকমতো খেল? কোনও ভাবেই কি ওর কাছে চলে যেতে পারি না? কবেই বা পারব?”
এই প্রশ্নের উত্তর আজ অজানা। উত্তর নয়, তাঁরা খুঁজছেন অন্য কিছু...
রাতের তারা নয়, বিমানের আলো খুঁজছেন শ্রাবন্তী রাতের আকাশে! আর বিশ্বজিৎ? হন্যে হয়ে খুঁজছেন বাড়ি ফেরার টিকিট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy