হাতে রয়েছে ক্যালকুলেটর। আর ২০১৭ পর্যন্ত দিন গোনা। বিদেশের ব্যাঙ্কে থাকা কালো টাকা উদ্ধার করতে নেমে নরেন্দ্র মোদী সরকার আপাতত আর কোনও রাস্তাই খুঁজে পাচ্ছে না।
বিভিন্ন দেশ বিদেশিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নিয়ে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান শুরু করবে ২০১৭ থেকে। তবে সবাই নয়। মাত্র ৫৮টি। তার পরের বছর আরও ৩৬টি দেশের সরকার সেই তথ্য আদানপ্রদানের ব্যবস্থায় যোগ দেবে। যার মধ্যে কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্য বলে কুখ্যাত বেশ কিছু দেশ রয়েছে। আপাত ভাবে এটা আশার কথা মনে হলেও তিনটি বিষয় ঘোর চিন্তায় রাখছে অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের।
• আশঙ্কা এক, ২০১৭-’১৮ সালে তথ্য আদানপ্রদান শুরু হওয়ার আগে, মাঝের এই সময়টাতে হয়তো বিদেশের ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের কালো টাকার খোঁজ পাওয়ার কোনও রাস্তাই মিলবে না।
• আশঙ্কা দুই, কালো টাকার মালিকদের হাতে এখনও অনেকটা সময়। এর মধ্যেই কালো টাকা সরিয়ে ফেলে তারা তথ্য-প্রমাণ লোপাট করে ফেলবে না তো!
• আশঙ্কা তিন, ২০১৭ থেকে স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদানপ্রদানের ব্যবস্থা তথা ‘অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন’ চালু হলেই যে কালো টাকার সব তথ্য হাতে চলে আসবে এমনও নয়। সে সময় যে সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেগুলির তথ্য মিলবে। তবে নির্দিষ্ট কোনও লেনদেন নিয়ে সন্দেহ হলে তবেই পুরনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়ে নিতে হবে। আর সন্দেহ না হলে ধরা পড়ার বদলে জাল কেটে বেরিয়ে যাওয়ারই ১৬ আনা সম্ভাবনা।
নরেন্দ্র মোদীর কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি পূরণের তবে কী হবে? সেটা নিয়েই এখন জোর জল্পনা শুরু হয়েছে সরকারের অন্দরমহলে।
স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে কর ও জরিমানা দিয়ে কালো টাকার কথা জানানোর জন্য তিন মাসের জানলা খুলে দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রক। কিন্তু তিন মাসে মাত্র ৬৩৮ জন ৩,৭৭০ কোটি টাকার কথা জানিয়েছেন। সুইস ব্যাঙ্ক বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে কালো টাকা জমানোর খেলায় এই ৬৩৮ জন নেহাতই চুনোপুঁটি বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রক। মাত্র ৩,৭৭০ কোটি টাকার অঙ্কও মোট কালো টাকার হিসেবের তুলনাই খুবই সামান্য। ভারতীয়দের কত কালো টাকা বিদেশে রয়েছে, তার নানা রকম আনুমানিক হিসেব রয়েছে। কোনটা যে ঠিক, কেউই জানে না। সরকারি হিসেবও অমিল। ওয়াশিংটনের ‘গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি’ সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১১-র মধ্যে ভারত থেকে কর ফাঁকি দিয়ে অন্তত ৩৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। তিন মাসে খোঁজ মেলা ৩,৭৭০ কোটি টাকা তো তার ছিটেফোঁটা মাত্র! স্বাভাবিক ভাবেই এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী দলগুলি এখন সরব হয়ে উঠেছে।
এর মধ্যেও অবশ্য অর্থ মন্ত্রকের রাজস্বসচিব শক্তিকান্ত দাস আজ হুঁশিয়ারি দিয়ে টুইট করেছেন, ‘‘যারা তিন মাসে কালো টাকার কথা জানালেন না, তাঁরা তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষমতা বুঝতে পারলেন না। পরে তাঁদের কপাল চাপড়াতে হবে।’’ কিন্তু সত্যিই কি কপাল চাপড়াতে হবে? অর্থ মন্ত্রকের অনেক কর্তাই এতটা আত্মবিশ্বাসী নন। কারণ, ২০১৭-র এখনও অনেক দেরি। সন্দেহ নেই, মাঝের এই সময়টাকে পুরো দস্তুর কাজে লাগাবে কালো টাকার কারবারিরা।
কী ভাবে? রাজস্ব দফতরের এক কর্তা বললেন, ‘‘এই সময়ের মধ্যে অনেকেই সুইস ব্যাঙ্ক থেকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে টাকা সরিয়ে ফেলতে পারেন। সরকারের নজরদারি এড়িয়ে হাওয়ালার মাধ্যমে এ দেশেও টাকা ঢুকছে। বেনামি সংস্থায় টাকা রাখার ঘটনা তো ঘটেই। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে হাতবদল হয়ে যাওয়ার পরে সেই টাকার আর কোনও সন্ধানই মেলে না। সুইস ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে তা সিঙ্গাপুরের কোনও সংস্থায় লগ্নি করে দেওয়া হয়। এর পরে সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলে কার টাকা কোথায় ঢুকেছে, তার খোঁজ মেলাই মুশকিল হয়ে পড়বে।’’
অর্থ মন্ত্রকের অবশ্য দাবি, সামগ্রিক ছবিটা এত খারাপ নয়। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্তরে তথ্য আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করছে। কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্য লিকটিনস্টাইনে এলজিটি ব্যাঙ্কে এবং এইচএসবিসি-র জেনিভা শাখায় যে সব ভারতীয়ের অ্যাকাউন্ট রয়েছে, আগেই তার তথ্য পেয়েছে দিল্লি। কর ফাঁকির আর এক স্বর্গরাজ্য ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে যে সব ভারতীয় ব্যবসায়িক সংস্থা খুলেছেন, তাঁদের তালিকাও মিলেছে। প্রথম দু’টি তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কর ফাঁকি সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদানের চুক্তি হলে সেখান থেকেও তথ্য মিলবে। ২০১৭-র পরে বিভিন্ন দেশের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান শুরু হলে আরও তথ্য মিলবে। এখন তারই অপেক্ষা।
কিন্তু এতে ২০১৯-এর নির্বাচনের আগে কিছু কালো টাকা কি দেশে ফেরানো যাবে? অরুণ জেটলির অর্থ মন্ত্রক শুধু নয়, গোটা বিজেপি নেতৃত্বের সামনেই এটা এখন বড় প্রশ্ন। কালো টাকা ফেরাতে মোদী-ঘোষিত তিন মাসের সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে সেই কবেই। এখন তা-ও ক্যালকুলেটর হাতে অঙ্ক কষা চলছে। ভোটের মুখে গিয়েও এমন না হয়, হাতে রইল পেন্সিল!
বিজেপি নেতৃত্ব তাই আশায় বুক বাঁধছেন, কালো টাকা উদ্ধার না হলেও ভোটের আগে কিছু তথ্য যেন মেলে। তা দিয়েও মুখরক্ষার একটা চেষ্টা অন্তত করা যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy