ভোরের সংবাদপত্র যখন জানাচ্ছে, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস-শিবসেনা-এনসিপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন শিবসেনা-প্রধান উদ্ধব ঠাকরে, তখন মহারাষ্ট্র থেকে খবর এল, সেই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ফেলেছেন বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস!
মাঝরাতে কী এমন হল যাতে এই নাটকীয় পট পরিবর্তন? বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, মাঝরাতের এই ‘অভ্যুত্থান’ কার্যত জরুরি অবস্থাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল না। তা সত্ত্বেও কেন এত তড়িঘড়ি করে রাত দু’টোর সময় দেবেন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন রাজ্যপাল? বিরোধীরা এ-ও বলছেন যে, নেতাদের না-হয় সরকার গড়ার জন্য নিশিলণ্ঠনের তেল পোড়ানোর দায় রয়েছে। কিন্তু সাংবিধানিক পদের দুই অন্যতম বয়স্ক ব্যক্তি রাত দু’টোর সময় কেন জেগে?
রাত দু’টোয় দেবেন্দ্র দেখা করলেন রাজ্যপাল ভগৎসিংহ কোশিয়ারীর সঙ্গে। আর রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহার করা হয় ভোর পৌনে ছ’টায়। শেষ রাতের এই ‘রহস্যময়’ পৌনে চার ঘণ্টা ঠিক কী ঘটেছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন বিস্তর।
ভগৎ সিংহ কোশিয়ারী, রাজ্যপাল, মহারাষ্ট্র
• আরএসএস সদস্য, পরে বিজেপির
• বিজেপির জাতীয় সহ সভাপতি ছিলেন, উত্তরাখণ্ডে দলের প্রথম রাজ্য সভাপতি
• উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী
• রাজ্যসভা এবং লোকসভায় উভয় কক্ষেরই সদস্য ছিলেন
• সাংবাদিকতাও করেছেন
কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেলের কথায়, ‘‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে।’’ দলের আর এক নেতা রণদীপসিংহ সুরজেওয়ালা বলেছেন, ‘‘অমিত শাহের হিটম্যান হিসেবে কাজ করেছেন রাজ্যপাল।’’ এখানেই না-থেমে তিনি বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ দেশের সংবিধানকে পায়ের তলায় পিষে দিয়েছেন। সুযোগসন্ধানী অজিত পওয়ারকে জেলের ভয় দেখিয়ে, ক্ষমতার মোহে অন্ধ বিজেপি, সুপারি দিয়ে খুন করানোর মতো আজ গণতন্ত্রেকে হত্যা করিয়েছে। বিজেপি এবং অজিত পওয়ার মিলে দুর্যোধন এবং শকুনির মতো মহারাষ্ট্রের জনমতের বস্ত্রহরণ করেছেন। সত্যিই, মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়!’’
সরব হয়েছেন অন্য বিরোধী নেতারাও। টুইট করেছেন বন্দি পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। লিখেছেন, ‘‘রাজভবনের ফ্যাক্স মেশিন রহস্যময়। ভোর পাঁচটা সাতাশ মিনিটে রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে বিজেপির সরকার গড়ার জন্য সুপারিশ করতে পারে। কিন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বরে যখন পিডিপি, এনসি এবং কংগ্রেস মিলে জম্মু-কাশ্মীরে নতুন সরকার গড়ার দাবি জানায় তখন ওই মেশিন কাজ করে না! নতুন ডিজিটাল ভারত!’’ সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিংহ যাদব বলেছেন, ‘‘এখন তো মনে হচ্ছে, রাজ্যপাল যার সরকার তার।’’ বিরোধী নেতাদের অনেকের মতেই, এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে জরুরি অবস্থাকে। সরকারি নিয়মের একটি ধারা বলছে, প্রধানমন্ত্রী চাইলে যে কোনও নিয়মকে এড়িয়ে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারেন। এখানে ঠিক সেটাই ঘটেছে। কংগ্রেস, শিবসেনা এবং এনসিপি— তিন দল মিলে রাজ্যপালের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন করেছে সুপ্রিম কোর্টে।
বিরোধীদের যাবতীয় অভিযোগের জবাবে আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, ‘‘রাজ্যপালের বিবেক রয়েছে। তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন বলেই সরকার গড়তে ডেকেছেন।’’ রাষ্ট্রপতি শাসন তোলার প্রশ্নে কি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে, কারা ছিলেন সেই বৈঠকে, মন্ত্রিসভা কি অনুমোদন দিয়েছে এই সিদ্ধান্তে? বিরোধীদের এই সব প্রশ্নের উত্তরে রবিশঙ্করের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই মন্ত্রিসভার পুরো ক্ষমতা নিহিত রয়েছে।’’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহও এই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করেন।
রাজনীতির খবর রাখা লোকজনের বক্তব্য, নোটবন্দির ঘোষণার পরে মোদী বলেছিলেন, তিনি যে কোনও বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ইঙ্গিত তথা ‘ক্লু’ দিয়ে থাকেন। নোটবন্দির পদক্ষেপের আগে অনেক প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যা নাকি কেউ বুঝতে পারেনি। মহারাষ্ট্রে নটকীয় পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও ‘ক্লু’ দেওয়া হয়েছিল যা সবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে! কী সেটা?
নয়াদিল্লিতে গত কাল দেশের সব রাজ্যের রাজ্যপালেরা দিল্লিতে ছিলেন। উপরাষ্ট্রপতির সঙ্গে সস্ত্রীক ছবি তুলেছেন তাঁরা। কিন্তু এক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সেই ছবিতে নেই! মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল। প্রশ্ন উঠছে, এর মানে কি আগে থেকেই পরিকল্পনার নীল নকশা ছিল রাজ্যপাল কশিয়ারীর কাছে? তাই কি তিনি দিল্লি না এসে অপেক্ষা করছিলেন মহারাষ্ট্রেই?