ফাইল চিত্র।
আইএএস অফিসারদের ক্যাডার বিধি সংশোধন করতে চায় কেন্দ্র। তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই পরিস্থিতিতে আইএএস অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, পূর্বতন বিধি অনুযায়ী যে সংখ্যক আইএএস কেন্দ্রীয় সরকারে ডেপুটেশনে পাঠানোর কথা, বহু রাজ্য তা মানছে না। তার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলিতে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তাই বিধি সংশোধনের পথে হাঁটতে হচ্ছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্যের যুক্তি, তাঁদের হাতে যে সংখ্যক আইএএস থাকার কথা তা নেই। রাজ্যে কাজের চাপও রয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে ছাড়া হচ্ছে না।
আইএএস মহলের একাংশ জানাচ্ছে, বর্তমান সমীকরণ অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের অনুমোদিত আইএএস ক্যাডারের সংখ্যা ৩৭৮ (সর্বাধিক এত জন অফিসার পেতে পারে রাজ্য)। কিন্তু বর্তমানে ২৮৩ জন আইএএস অফিসার রয়েছেন। বিধি অনুযায়ী, এর সর্বাধিক ৪০% অর্থাৎ প্রায় ৮২ জন অফিসারকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে পাঠানো যায়। কিন্তু বর্তমানে রাজ্য থেকে কেন্দ্রের ডেপুটেশনে রয়েছেন মাত্র সাত জন আইএএস অফিসার। অর্থাৎ সর্বোচ্চ সংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ। এই পরিস্থিতি শুধু এ রাজ্যেই নয়। বরং একাধিক রাজ্যের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটছে।
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, ক্যাডার আইন বা তার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালে তৈরি বিধির চার নম্বর ধারা অনুযায়ী কেন্দ্র-রাজ্যের সহমতে ক্যাডারের শক্তি (কোন ক্যাডারে কত জন অফিসার থাকবেন) নির্ধারিত হয়েছিল। যার উল্লেখ রয়েছে ১৯৫৫ সালের আইএএস (ফিক্সেশন অব ক্যাডার স্ট্রেংথ) বিধিতে। পরবর্তীতে এটিরও সংশোধন হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। অর্থাৎ, নিয়োগ করবে কেন্দ্র। প্রশিক্ষণ শেষে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্যে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি, কোনও রাজ্যে কতগুলি পদে কতজন অফিসার থাকবেন, নির্দিষ্ট সময়ে সেই রাজ্য থেকে কতজন অফিসার কেন্দ্রের ডেপুটেশনে যাবেন, প্রশিক্ষণ-পদোন্নতি-সিনিয়র জুনিয়র পদবিন্যাস সবই নির্দিষ্ট রয়েছে ওই বিধিতে।
কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক সূত্র অনুসারেও, ২০১১ সালের পর থেকে কেন্দ্রে যাওয়া অফিসারের সংধ্যা ২৫% থেকে কমে হয়েছে ১৮%। অফিসারদের এই ঘাটতি মেটাতে রাজ্যগুলিকে বার বার অনুরোধ করা হয়েছিল। কাজ না হওয়ায় বিধি সংশোধন করা এখন জরুরি। ওই সূত্রের দাবি, এতে রাজ্যের সঙ্গে রীতিমাফিক আলোচনা হবে। তবে আপত্তি থাকলেও জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইএএস অফিসারকে ছাড়তে হবে সেই রাজ্যকে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ওই সূত্রের পর্যবেক্ষণ, রাজ্যে সিনিয়র পদ রয়েছে প্রায় ২০৫টি। তার অনেক পদেই তুলনায় জুনিয়র অফিসারেরা কর্মরত রয়েছেন। আবার অনেক সিনিয়র অফিসার তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ বা প্রান্তিক পদে কর্মরত। তাঁদের অনেকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনের জন্য বিবেচিত হলেও রাজ্য ছাড়ছে না। এটাও ইতিবাচক ক্যাডার নীতির পরিচয় বহন করে না।
রাজ্যেরও পাল্টা যুক্তি, আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করলে ইতিবাচক বার্তা প্রতিষ্ঠিত হত। কিন্তু তার বদলে কেন্দ্র বলছে, তাদের ইচ্ছা মতো কোনও অফিসারকে দেশের যে কোনও প্রান্তের একটি পদে বদলি করা যেতে পারে! এতে রাজ্য বা সেই অফিসারের মতের কোনও গুরুত্ব থাকবে না। এই পদক্ষেপ শুধু গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনকই নয়, বরং অফিসারদের মনোবলকে পুরোপুরি ভেঙে দিতে যথেষ্ট। সত্তরের দশকে কেশবানন্দ ভারতী থেকে নব্বইয়ের দশকে এস আর বোম্মাই পর্যন্ত অনেক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রিকতাই ভারতীয় সংবিধানের মৌল বৈশিষ্ট্য। তাকে ধাক্কা দেয়, এমন আইন গ্রাহ্য হবে না। তাই এ ব্যাপারে কেন্দ্র অনড় হলে কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারে রাজ্য। রাজ্যের ওজর-আপত্তি অগ্রাহ্য করে আইএএস অফিসারদের ডেকে নেওয়ার যে নতুন বিধির কথা কেন্দ্র বলছে, তার প্রতিবাদে এ দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছেন তেলঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও। এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ আরও বেশ কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রীও এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন মোদীকে।
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব জহর সরকার বলছেন, “কেন্দ্র নিজেও বোঝে, চাদরের মাপটা ছোট। তাই পুরো শরীর ঢাকা যাবে না। কারণ, অফিসার নিয়োগ করে তারাই। রাজ্যে অফিসারের সংখ্যা না বাড়ালে সমস্যা থেকে যাবে। তাই আরও দূরদৃষ্টি নিয়ে উদার মনে পদক্ষেপ জরুরি।” আরেক প্রাক্তন আইএএস বলেন, “রাজ্য বা সংশ্লিষ্ট অফিসারের মতামত ছাড়া তাঁকে দেশের এক প্রান্ত থেকে তুলে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার মনোভাবের নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও কাজ করতে পারে।”
তবে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে পাঠানোর পিছনে রাজ্যের স্বার্থও থাকে বলে জানান অনেকে। তাঁরা বলছেন, চন্দ্রবাবু নায়ডুর আমলে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বহু অফিসারকে কেন্দ্রের ডেপুটেশনে পাঠানোর চেষ্টা হত। এই ধারা অনুসরণ করে ওড়িশা-সহ কয়েকটি রাজ্যও। কারণ, কেন্দ্রে নতুন প্রকল্প, অনুদান, বরাদ্দ বা বিনিয়োগ সম্ভাবনা তৈরি হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের অফিসারেরা নিজেদের ক্যাডার রাজ্যকে সেই সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাতে রাজ্যের মানুষের লাভ হয়। কেন্দ্রীয় ডেপুটেশন সেরে রাজ্যে ফিরে ভাল পদের আশা থাকে সংশ্লিষ্ট অফিসারেরও। বিধি সংশোধন হলে সব কিছুই গুলিয়ে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে আমলাদের অনেকের আর্জি, মানুষ এবং সুপ্রশাসনের স্বার্থে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়েরই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টাই করা উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy