স্থানীয় বিজেপি নেতারা বলছেন, প্রথম দফার ৫৮ আসনের ফল ভাল না হলে তার ‘দায়’ বর্তাবে মোদীর উপর। যোগীর উপর নয়। কারণ, কৃষি আইন মোদীর। যোগীর নয়। তাঁদের কথায়, ‘‘কৃষি আইন কি বাবার (ভক্তরা যোগী আদিত্যনাথকে এই নামেই ডেকে থাকেন) মাথা থেকে বেরিয়েছিল? ওটা তো মোদীর আইন!
নরেন্দ্র মোদী ভাবতে পারেননি, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সম্পন্ন কৃষকরা দল বেঁধে তাঁর সরকারের প্রণীত আইনের বিরোধিতা করবেন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দূর থেকে চোখে পড়ছিল, আকাশে চিল আর শকুন উড়ছে। ভোরের আলো ফুটছে সবে। দিল্লি-মেরঠ হাইওয়ে ধরে তখনও গাড়ির ভিড় শুরু হয়নি। মসৃণ রাস্তা ধরে চলতে চলতেই নজরে এল দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানায় গাজিপুরের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে চিল-শকুন। কখনও কখনও তারা নেমে আসছে বিপজ্জনক ভাবে। প্রায় মাটির কাছাকাছি।
গাজিপুর! জয়ের ধাত্রীভূমি। পরাজয়েরও।
দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানার গাজিপুর। আন্দোলনের গাজিপুর। যার আরও দুই আন্দোলনতুতো ভাই আছে আশেপাশে। রাজধানী দিল্লির সীমানায়। হরিয়ানা সীমানায়। সিঙ্ঘু এবং টিকরি।
কিসের আন্দোলন? কৃষক আন্দোলন। যে আন্দোলনের সামনে নতিস্বীকার করেছিলেন প্রবল পরাক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মোদীর দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে প্রথম ক্ষমা চাওয়া। সে অর্থে দেখতে গেলে এই গাজিপুর সীমানা ইতিহাসের ধাত্রীভূমি। ইতিহাস জয়ের। পরাজয়েরও।
পূর্ব দিল্লির পটপড়গঞ্জ থেকে মেরঠের দিকে কিলোমিটার দশেক এগিয়ে গেলেই পড়ে গাজিপুর। বিশাল মান্ডি রয়েছে এখানে। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে আনাজপাতি, ফল, ফুল— এই সমস্ত কিছু দিল্লির বাজারে আসে গাজিপুর মান্ডি থেকে। উপর দিয়ে চলে গিয়েছে চার লেনের ‘এলিভেটেড হাইওয়ে’। নীচে একপাশে বাজার। মান্ডি।
গত ১৯ নভেম্বর মোদী যখন কৃষি আইন বলবৎ করার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন, তখন গাজিপুর সীমান্তে মিষ্টি বিলি হয়েছিল। কিন্তু কোনও উচ্ছ্বাস ছিল না। কারণ, কৃষকেরা চেয়েছিলেন, যত দিন না সংসদে ওই বিতর্কিত আইন প্রত্যাহার করা হয়, তত দিন তাঁরা উচ্ছ্বসিত হবেন না। সেটা হয়েছিল ২৯ নভেম্বর। তার তিন-চারদিন পর এলাকা ফাঁকা হয়েছিল। পুরো হাইওয়ে সাফ করে দিয়ে গিয়েছিলেন কৃষকেরা। একটা ভাতের দানাও পড়ে ছিল না!
কৃষক অবরোধে যোগ-দেওয়া সিঙ্ঘু যেমন শিখপ্রধান, গাজিপুর তেমনই জাঠপ্রধান। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা যোগ দিয়েছিলেন গাজিপুরের আন্দোলনে। তাঁদের নেতা ছিলেন রাকেশ টিকায়েত। উত্তরপ্রদেশের জাঠ সম্প্রদায়ের কৃষকেরা প্রত্যেকে যথেষ্ট সম্পন্ন। গড়ে অন্তত পাঁচ একর করে জমির মালিক। এঁরা আখচাষ করেন। যা কৃষকের পরিভাষায় ‘দামি ফসল’। এঁরাই এসেছিলেন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে। মেরঠ থেকে গাজিয়াবাদ পর্যন্ত এলাকার বাসিন্দা যাঁরা। ২৬ জানুয়ারি লালকেল্লা অভিযানের আগে এক সঙ্গে ৫,০০০ কৃষক অবস্থানে বসেছিলেন দিল্লি-মেরঠ হাইওয়ের দিল্লিগামী লেন জুড়ে।
হাইওয়ের উপরে মঞ্চ। কিছু তাঁবু। নীচের রাস্তাতেও তাঁবু আর ট্র্যাক্টর। সেখানে অবস্থানরত বাকিরা। ২৬ জানুয়ারির ঘটনার পর সেই সংখ্যা কমে হাজার থেকে দেড়হাজারে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু অবস্থান কখনও উঠে যায়নি।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলছিলেন, ‘‘বিভিন্ন ভাবে কৃষকদের আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। ছলে-বলে-কৌশলে। কিন্তু তাঁদের টলানো যায়নি। কৃষি আইন বাতিল না-করলে তাঁরা কোনও আপসের রাস্তায় যেতে চাননি।’’ ঠিকই। টানা ১৫ মাস ধরে মাটি কামড়ে আন্দোলন করেছিলেন কৃষকেরা। মোদীকে নত হতে বাধ্য করেছিলেন। ঝোঁকেননি। ৩৫টি সংগঠন কাঁধে-কাঁধ, হাতে-হাত রেখে চলেছিলেন। তাঁরা জোটবদ্ধ হয়ে চলছিলেন। সে ভাবেই তাঁরা চলেছেন। এবং জিতেছেন।
মোদী ভাবতে পারেননি, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা ওই আন্দোলন যোগ দেবেন। কারণ, এই জাঠ কৃষকেরা প্রকাশ্যেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ‘এনকাউন্টার তত্ত্ব’-এর প্রশংসা করেছিলেন। বস্তুত, পঞ্জাবের কৃষকেরা যখন আন্দোলন শুরু করেন, তখনও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা তাতে যোগ দেননি। তাঁরা এসেছিলেন পরে। সেটাও বিজেপি তথা মোদীর ভাবনার অতীত ছিল। তিনি ভাবতে পারেননি, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সম্পন্ন কৃষকরা দল বেঁধে তাঁর সরকারের প্রণীত আইনের বিরোধিতা করবেন।
মোদী ক্ষমাপ্রার্থনা করে কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছিলেন গুরু নানকের জন্মদিবসে। কিন্তু সকলে জানতেন, সেই ঘোষণা পঞ্জাবের জন্য ছিল না। ছিল পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জন্য। কারণ, ফেব্রুয়ারি-মার্চে উত্তরপ্রদেশে মহাগুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা ভোট।
যে ভোটের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে ২০২৪ সালে মোদীর দিল্লির তখ্তে ফিরে আসার সম্ভাবনা। যে ভোট হয়ে গেল গত ১০ ফেব্রুয়ারি, উত্তরপ্রদেশে মোট সাত দফার প্রথম দফা ভোটে।
মোদীর ক্ষমাপ্রার্থনা করে কৃষি আইন প্রত্যাহার করা কি ছাপ ফেলেছে সেই ভোটে?
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মাটির সঙ্গে যোগাযোগ-সম্পন্ন স্থানীয় বিজেপি নেতাদের কথা বিশ্বাস করতে গেলে, ছাপ ফেলেছে। কিন্তু নেতিবাচক ছাপ। ক্ষতি হয়েছে। কতটা হয়েছে, সেটা বোঝা যাবে ১০ মার্চ ভোটের ফল ঘোষণার পর। তাঁদের কথায়, ‘‘ডেন্ট তো হুয়া হ্যায় জরুর! অব কিতনা হুয়া হ্যায়, ওহ্ তো দস মার্চ পতা চলেগা।’’ পাশাপাশিই তাঁরা বলছেন, বিজেপি যদি প্রথম দফার ৫৮টি আসনের ভোটে ভাল ফল না-করে, তা হলে তার ‘দায়’ বর্তাবে মোদীর উপর। যোগীর উপর নয়। তাঁদের কথায়, ‘‘কৃষি আইন কি বাবার (ভক্তরা যোগী আদিত্যনাথকে এই নামেই ডেকে থাকেন) মাথা থেকে বেরিয়েছিল? ওটা তো মোদীর আইন! সেই আইন আনার ফলেই তো কৃষক আন্দোলন! তার কোনও খারাপ ফল যদি উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে পড়ে, তার দায় বাবার কেন হতে যাবে! তার দায় তো মোদীর।’’
নরেন্দ্র মোদী কি সে কথা জানেন? কে জানে!
গাজিপুর-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, এখানেই ঘটেছিল সেই ঐতিহাসিক আন্দোলন! উপরের হাইওয়ে চলে গিয়েছে বৈশালী, মোরাদাবাদ, মেরঠ। সেই হাইওয়ের তলায় রাস্তার পাশে এখনও ডাঁই করে রাখা কংক্রিটের বড় বড় চাঁইয়ের ব্যারিকেড। গায়ে কাঁচা হাতে চুন দিয়ে লেখা ‘ইস্ট ডিস্ট্রিক্ট’। অর্থাৎ, পূর্ব দিল্লি। অর্থাৎ, পূর্ব দিল্লি পুলিশ। রাস্তার এক পাশ দিয়ে মান্ডির দিকে চলে যাচ্ছে ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা। ঘোড়ার খুরে লাগানো নাল থেকে পিচের রাস্তায় কপ-কপ, কপ-কপ আওয়াজ উঠছে।
রাস্তার পাশে বাবলা গাছের ঝোপ। তার উপর খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে চিল-শকুনের ঝাঁক। কখনও কখনও এতটাই নীচে নেমে আসছে যে, মনে হচ্ছে, ঠোকর না মারে! তাদের লক্ষ্য পাইকারি দরে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর পড়ে-থাকা মাছ-মাংসের উচ্ছিষ্ট। যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের খুবলে খেতে আকাশ থেকে নেমে আসে চিল-শকুনের দল।
জয়ের ধাত্রীভূমি। পরাজয়েরও। গাজিপুর সীমানায় সূর্যোদয়ের আভা ছড়িয়ে পড়ছিল। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy