Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Indian Railways

ট্রেন বেসরকারীকরণ আশার কথা, কিন্তু আশঙ্কাও কম নেই

গত তিরিশ বছরে দেশের যাত্রিবাহী ট্রেনের অনেক উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু উন্নত দেশের তুলনায় তা কতটা? 

ভারতীয় রেলের আধুনিক ট্রেন তেজস এক্সপ্রেস। বেসরকারীকরণ গতি এবং পরিষেবা দুই-ই বাড়াবে বলে মনে করছেন অনেকে। —ফাইল চিত্র।

ভারতীয় রেলের আধুনিক ট্রেন তেজস এক্সপ্রেস। বেসরকারীকরণ গতি এবং পরিষেবা দুই-ই বাড়াবে বলে মনে করছেন অনেকে। —ফাইল চিত্র।

সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২০ ১৯:৩৭
Share: Save:

১৯৮৮। মুম্বই থেকে আমদাবাদ আসছিল প্লেনটি। ১২৯ জন যাত্রী নিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭ ভেঙে পড়েছিল নামার মুখে। দু’জন ছাড়া সবাই মারা গিয়েছিলেন। মৃতদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাধিক প্রথিতযশা শিক্ষক।

তার পর থেকে দীর্ঘ কাল বন্ধ ছিল আমদাবাদ বিমানবন্দর। বাকি দেশের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল ট্রেন। আর সেই যাত্রা ছিল বিভীষিকার। ছাত্রজীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, গরমের ছুটিতে দু’রাতের সেই যাত্রা ছিল নরকতুল্য। ট্রেন থেকে নামার পরে মাল-বাহকরা পর্যন্ত নাকে কাপড় দিতেন।

বর্তমানে কী অবস্থা ওই রুটের তা বলতে পারব না। কারণ, এখন সাধারণ মধ্যবিত্তও দীর্ঘ যাত্রাপথ পারলে প্লেনেই গিয়ে থাকেন। কিন্তু তখন মনে হতো, যাত্রার অভিজ্ঞতাটা আর একটু কি ভাল হতে পারে না? ঘটনা হল, অন্যান্য রুটেও যে এই অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ছিল তা বলতে পারব না।

এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই, যখন প্রথম গত সপ্তাহে ১০৯টি রুটে ১৫১টি ট্রেন বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র, তখন মনে হয়েছিল— কেন নয়! গত তিরিশ বছরে দেশের যাত্রিবাহী ট্রেনের অনেক উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু উন্নত দেশের তুলনায় তা কতটা?

বিদেশে ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা জানেন যে আমাদের যাত্রী ট্রেনের কী দুরবস্থা। যতটা হওয়ার কথা ছিল তার থেকেও খারাপ। মনে আছে, আমদাবাদ এক্সপ্রেসে বাথরুম পরিষ্কার করাতে কালঘাম ছুটে যেত। যাত্রাকালে এটা তো সাধারণ চাহিদা! কিন্তু বিপুল বহরের এই প্রতিষ্ঠানটি তার গ্রাহকদের জন্য এই ব্যবস্থাটিও সুষ্ঠু ভাবে করে উঠতে পারেনি। আর এই বেসরকারি ট্রেনের কথা শুনেই মনে হয়েছিল— যাক!

আরও পড়ুন: টেন-টুয়েলভের না হওয়া পরীক্ষার নম্বর কী ভাবে দেওয়া হচ্ছে

ব্যবসার বহর, দেশের চাহিদা এবং অবশ্যই লাভ-ক্ষতির অঙ্ক— মনে রাখতে হবে ভারতীয় রেল দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহত্তম পরিবহণ পরিকাঠামো। কিন্তু দেশের চাহিদা মিটিয়ে খরচ ও আয়ের সামঞ্জস্য রাখতে গলদঘর্ম সংস্থাটি। গত আর্থির বছরেই যদি এনটিপিসি-র মতো সংস্থার থেকে অগ্রিম না পেত রেল, তা হলে প্রতি ১০০ টাকা আয়ের জন্য ১০২.৬৬ টাকা খরচ (অপারেটিং রেশিও) করতে হত সংস্থাটিকে। আর এই আগাম টাকা পাওয়াতেই অপারেটিং রেশিও কমে দাঁড়ায় প্রতি ১০০ টাকা আয়ে ৯৮.৪৪ টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্য দাবি যে সংস্থাটির খাতায় এখনও লাভই দেখা যাচ্ছে। এর সারমর্মের বিচার অন্য আলোচনা দাবি করে। আমরা ফিরি বেসরকারি ট্রেনের হিসাবে।

রেল লাইনের পাশে দাঁড়ালেই তো একটা সমস্যা চোখের সামনে উঠে আসে। ভিড়। অর্থাৎ ট্রেনের চাহিদার তুলনায় জোগান কম। সরকারি হিসাব বলছে, ১৩ হাজার ট্রেন নাকি চলে। প্রয়োজন ২০ হাজার ট্রেনের। এখনই। তারই সঙ্গে প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি থেকে শুরু করে গোটা পরিকাঠামোর উন্নয়ন। কিন্তু তা করতে প্রয়োজন কয়েক লক্ষ কোটি টাকার। ২০১৯ সালের সরকারি হিসাবই বলছে, এই খাতে প্রয়োজন ৫০ লক্ষ কোটি টাকা। হ্যাঁ, ৫০ লক্ষ কোটি।

এটা কতটা? চলতি আর্থিক বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের আনুমানিক গোটা আয় ধরা হয়েছে সাড়ে ২২ লক্ষ কোটি টাকার একটু কম! অর্থাৎ কেন্দ্রের গোটা বছরের আয়ের দ্বিগুণেরও বেশি টাকা যাবে রেলের আধুনিকীকরণের খরচ জোগাতে। অবশ্যই এক বছরে নয়। কিন্তু প্রয়োজনের বহর বোঝার জন্য এই তুলনাটা যথেষ্ট। এ দিকে কোষাগার তো শূন্য। তা হলে উপায়? সহজ রাস্তাটি সেই বেসরকারীকরণই। সরকার সেই সহজ রাস্তাতে পা বাড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন: এ বার রেলের নিয়োগেও কোপ, পদ কমানোর নির্দেশ রেল বোর্ডের

সরকারের কাঁধে এখন যা দায় তাতে তো ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। চিন সীমান্তে দাপাচ্ছে। অথচ আমাদের প্রতিরক্ষা খাতে খরচের ক্ষমতাও তলানিতে। চলতি বছরের বাজেটে, প্রতিরক্ষার মূলধনী খাতে মাত্র সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি ছিল— এই মুহূর্তে প্রতিরক্ষা খাতে খরচের থেকেও উন্নয়নের অন্য খাতে খরচ অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু চিন বদলে দিয়েছে অঙ্কটা। তার উপর করোনার চাপ।

কিন্তু যদি এই সাঁড়াশি আক্রমণ না হতো, তা হলেও কি এই বেসরকারীকরণ হতো? কেন্দ্রের খরচের হাল এবং অভিজ্ঞতা কিন্তু বলছে, ‘হ্যাঁ।’ রবিবার কেন্দ্রীয় আর্থিক বিষয়ক সচিবও বলেছেন, দেশের বৃদ্ধিতে গতি আনতে পরিকাঠামোয় বেসরকারীকরণ একমাত্র উপায়।

কিন্তু সহজ পথের বিপদও অনেক।

ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাই দেখা যাক। ১৯৪৪ সাল থেকে ব্রিটেন রেলের বেসরকারীকরণ নিয়ে নানান পরীক্ষা করেছে। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে সেই প্রচেষ্টা খুব একটা সুখকর হয়নি। ১৯৯৩ সালের শেষ প্রচেষ্টাও সুখকর হয়নি। লন্ডনের মেট্রোতেই বেসরকারীকরণের চেষ্টা করা হয়। ২০১০ সালে আজকের প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন মেয়র বরিস জনসন তা আবার বেসরকারি সংস্থার হাত থেকে নিয়ে নিতে বাধ্য হন।

১৯৯৩ সালে যখন রেল বেসরকারীকরণ করা হয়, তখন পরিকাঠামোর জন্য তৈরি হয় রেলট্রাক নামে একটি সংস্থা যার শেয়ার বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর বিভিন্ন রুট বেচা হয় বিভিন্ন সংস্থাকে। কিন্তু রেলট্রাক প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায়, আবার তা সরকারের হাতে ফিরিয়ে নিতে হয়। যদিও বিভিন্ন রুট সে দেশে এখনও বেসরকারি সংস্থা চালায়, কিন্তু পরিচালনার ক্ষেত্রে সংঘর্ষ নিত্য দিনের ঘটনা।

রেলের মতো এত বড় একটা পরিকাঠামো কোনও একটি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিতে পারে না কোনও দেশই। তাই ব্রিটিশ সরকার যে ভাবে সড়ক পরিবহণ চলে, অর্থাৎ রাস্তা আর গাড়ি— বেসরকারীকরণের ক্ষেত্রে সে ভাবেই ভেবেছিল। আমরাও এখনও সে রাস্তাতেই হাঁটছি। এখানে সমস্যা হল ইচ্ছা মতো রাস্তা খুঁজে নিতে পারে গাড়ি। এ রাস্তা নয়ত অন্য রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। টোল রাস্তায় যেতে না চাইলে, তুলনামূলক ভাবে খারাপ রাস্তা বাছতে পারি। কিন্তু ট্রেন তা পারে না। অতএব দু’টি সংস্থার ট্রেন মারপিট করবে একই লাইনে নিজের সময়ে যেতে। না হয় রুট ও সময় বেঁধে দেওয়া হল। কিন্তু কোনও সংস্থা চাইল এমন আধুনিক ট্রেন চালাতে যার জন্য লাইনের ও সিগন্যালের আধুনিকীকরণ করা দরকার কিন্তু প্রতিযোগী সংস্থার তা দরকার নেই। তা হলে এই বিবাদ কে সামলাবে? সমস্যা হবে টিকিটের দাম নিয়েও। ব্রিটেনে নানান ভাড়ার ৪৫ শতাংশই সরকারের বেঁধে দেওয়া। আমাদের দেশে এই চিত্রটা এখনও পরিষ্কার নয়।

কিছু সমীক্ষা বলছে যে ব্রিটিশ রেলে নানান অ্যাক্সিডেন্টের মূলেই রয়েছে এই পরিবহণের সব পরিষেবাকে খণ্ড খণ্ড করে দেখা এবং বিভিন্ন খণ্ডের মধ্যে লাভ নিয়ে বিভেদ। এবং ব্রিটিশ রেলের বেসরকারীকরণের এই অভিজ্ঞতা কিন্তু গোটা বিশ্বের কাছে কী করা উচিত নয় তার উদারণ হয়ে রয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশ রেলের পুরোটাই চার ভাগে চারটি বেসরকারি সংস্থার হাতে ছিল। ক্লেমেন্ট অ্যাটলির আমলেই ব্রিটিশ রেলের সরকারি অধিগ্রহণ হয়। তার পর ১৯৯৩ সালে ব্রিটিশ রেলকে আবার বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টাতেই বর্তমান বিপত্তি বলে মনে করছেন অনেকেই।

কিন্তু বিশ্ব জুড়েই আজ রেল পরিবহণকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার একটা হিড়িক উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সদস্য দেশগুলিকে বলেছে, রেলের পরিকাঠামো ও যাত্রী পরিবহণকে আলাদা করে বেসরকারীকরণের রাস্তা হিসেবে বিবেচনা করতে। মনে রাখতে হবে ব্রিটেন হোক বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলিই হোক, আমাদের দেশের দারিদ্র এরা বহু শতক চোখেই দেখেনি। তাই মাথাপিছু আয়ে বহু শতক এগিয়ে থাকা দেশগুলিতেও যা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমাদের মতো দেশে তা যে বহু গুণ বেশি হবে তা নিয়ে কোনও সংশয়ই নেই। কী ভাবে তা আমরা মোকাবিলা করবে সরকার, বিশেষ করে আমাদের আর্থসামাজিক পরিকাঠামোতে, এখন সেটাই দেখার।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Railways Privatization Disinvestment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy