প্রতীকী চিত্র।
দৈনিক কাজের সর্বোচ্চ সময় বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার প্রস্তাবে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল প্রথম দিন থেকেই। এ বার ২৬ নভেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটের ডাকের মুখে তা উগরে দিতে শুরু করল অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন। সরব বাম দলগুলিও।
অভিযোগ, খাতায়-কলমে সাপ্তাহিক কাজের সময়ের সীমা একই (৬ দিনে ৮ ঘণ্টা করে মোট ৪৮ ঘণ্টা) রাখলেও আসলে ঘুরপথে কাজের মোট সময় বাড়াতে চাইছে কেন্দ্র। তোয়াক্কা করছে না সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের নিয়মকানুনেরও।
সংসদের শেষ অধিবেশনে পাশ হওয়া তিন শ্রম বিধির মধ্যে একটি ছিল কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত। সম্প্রতি এই বিধির নিয়মকানুনের খসড়া প্রকাশ করে ৪৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মহলের মতামত চেয়েছে কেন্দ্র। সেখানে বলা হয়েছে, ‘এক সপ্তাহে কোনও কর্মীকে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। টানা কাজ না-করিয়ে তার মধ্যে বিরতির বন্দোবস্ত রাখতে হবে। এক দিনে সর্বোচ্চ কাজের সময়ও ১২ ঘণ্টার বেশি হওয়া চলবে না।’
কর্মী সংগঠন এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কওরের কথায়, “এমনিতে দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করার কথা নয়। বিরতি, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির সময় ধরে তা দাঁড়াত ৯ ঘণ্টা মতো। প্রথমে কৌশলে তা বাড়িয়ে সাড়ে ১০ ঘণ্টা করার কথা বলেছিল সরকার। এখন খসড়ায় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সর্বোচ্চ সময় বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার! তার সঙ্গে ঘণ্টা তিন-চারেকের যাতায়াত ধরলে, এখানেই ১৫-১৬ ঘণ্টা। তা হলে আর বিশ্রাম কিংবা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ শ্রমিকেরা পাবেন কখন?”
ট্রেড ইউনিয়নগুলির অভিযোগ, অতিমারির পরে লগ্নি টানতে দৈনিক কাজের সময় বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করার পথে পা বাড়িয়েছিল উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাত-সহ বেশ কিছু রাজ্য। চুপ থেকে বিষয়টিতে পরোক্ষ ভাবে মদত জোগাচ্ছিল কেন্দ্র। বলা হচ্ছিল, কোভিডের সময়ে যেহেতু কম কর্মী নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, তাই আপাতত ৮ ঘণ্টার নিয়ম শিথিল করা জরুরি। কিন্তু প্রবল বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত পিছু হঠতে বাধ্য হয় রাজ্যগুলি। কিন্তু এখন খসড়া থেকে স্পষ্ট যে, আদপে বদল চাইছে কেন্দ্রই। তা ছাড়া, গুজরাতে ওই নিয়ম চালুর প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তা সত্ত্বেও ফের ১২ ঘণ্টার কথা কী করে বলা হচ্ছে, সেই প্রশ্নও তুলছে তারা।
কেন্দ্রের যুক্তি, কর্মীদের সাপ্তাহিক কাজের মোট সময় বাড়ানো লক্ষ্য নয় বলেই আন্তর্জাতিক বিধি মেনে সপ্তাহে মোট কাজের সময় ৪৮ ঘণ্টাতেই বেঁধে রাখা হয়েছে। বরং নতুন নিয়মে খুলে দেওয়া হচ্ছে বেশি ‘ওভারটাইম’ পাওয়ার রাস্তা। কিন্তু ইউটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষের আশঙ্কা, “এক বার ১২ ঘণ্টার ছাড়পত্র দিয়ে দিলে, সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার সীমা শুধু খাতায়-কলমেই থাকবে।” তাঁর প্রশ্ন, “বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৮ ঘণ্টার নিয়মেরই তোয়াক্কা করা হয় না। সেখানে আইনি ভাবে ১২ ঘণ্টার কথা বলা হলে, কর্মীদের কী দশা হবে?”
শ্রমিক সংগঠনগুলির বক্তব্য, দীর্ঘ সংগ্রামের পরে ৮ ঘণ্টার ওই নিয়ম চালু করা গিয়েছিল। শিল্পপতিদের খুশি করতে গিয়ে তা জলাঞ্জলি দিতে চাইছে সরকার। তার জন্য আন্তর্জাতিক বিধিকে থোড়াই কেয়ার করতেও পিছপা নয় তারা!
সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির টুইট, “কয়েক শতাব্দী লড়াইয়ের পরে তবে অর্জন করা গিয়েছিল দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ না-করার অধিকার। অথচ আইএলও-র সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই বিধির তোয়াক্কা করছে না কেন্দ্র। মনে রাখছে না সংবিধানে কর্মীদের দেওয়া আশ্বাসও।” এর বিরুদ্ধে তাই একজোট হয়ে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলি।
রবিবারই উত্তরপ্রদেশের জন্য প্রকল্প উদ্বোধনের ভিডিয়ো-অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লকডাউনের সময়ে কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের যত্ন সহকারে দেখভাল করেছে যোগী সরকার। চেষ্টা করেছে তাদের কাজের সুযোগ করে দিতে। আবার জি-২০-র অনুষ্ঠানে মোদীর আর্জি, শ্রমকে শুধু উৎপাদনের উপাদান হিসেবে গণ্য না-করে, লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষ হিসেবে প্রত্যেক কর্মীর প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করা। ট্রেড ইউনিয়নগুলির অভিযোগ, পায়ে হেঁটে বাড়ির পথ ধরা পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেককে যে যোগী সরকারের পুলিশের তাড়া খেতে হয়েছিল, সকলে তা দেখেছেন। অথচ এখন উল্টো কথা বলছেন মোদী! একই ভাবে, তিনি যখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে শ্রমিকদের সম্মান বজায় রাখার কথা বলছেন, তখন তাঁর সরকারই ব্যবস্থা করতে চাইছে শোষণের রাস্তা আরও খুলে দেওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy