প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
স্বচ্ছতা অভিযান, নরেন্দ্র মোদীর মুখের ছবি সম্বলিত রেশনের থলি বিতরণ, পাঁচ কোটি পোস্টকার্ড পাঠানো— এমন হাজারো পরিকল্পনা তো আছেই। প্রধানমন্ত্রীর একাত্তর বছরে পা রাখা আর সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রধান প্রশাসক হিসেবে দু’দশক পূর্ণ করাকে স্মরণীয় করে রাখতে এ বার নিশানা মোদীর জন্মদিনে রেকর্ড সংখ্যক টিকাকরণও!
শুক্রবার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে (১৭ সেপ্টেম্বর) দলের লক্ষ্যই হল, যত বেশি সংখ্যক সম্ভব মানুষকে কোভিডের টিকা দেওয়া। ওই দিনে রেকর্ড সংখ্যক টিকাকরণ যাতে হয়, সেই লক্ষ্য নিয়েছে দল। দলীয় সূত্রের দাবি, দেশ জুড়ে এখন মসৃণ গতিতে টিকাকরণ চালু রয়েছে। সম্প্রতি চোখে পড়ার মতো গতি বেড়েছে তার। তার দৌলতে দেশে সংক্রমণ আগের থেকে অনেকটাই কমেছে। এই কৃতিত্বের হকদার যে শুধু প্রধানমন্ত্রী, সেই বার্তা দিতেই তাঁর জন্মদিনকে রেকর্ড টিকাকরণের জন্য বেছে নিয়েছে দল।
গত দু’সপ্তাহে যে প্রতিষেধকের জোগান আগের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে, তা টিকাকরণের দৈনিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। কিন্তু বিরোধী শিবিরের একাংশের প্রশ্ন, ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে যেখানে এক দিন আগে কাউকে টিকা দিতে পারলেও সংক্রমণে রাশ টানার ক্ষেত্রে খানিকটা সুবিধা হয়, সেখানে রেকর্ড গড়তে একটি নির্দিষ্ট দিনের জন্য বসে থাকা কেন? যদি আগাম এমন পরিকল্পনা করা যায়, তার মানে তো হাতে টিকা রয়েছে। তা হলে তা আগেভাগে না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে দেওয়ার যুক্তি কী? এক বিরোধী নেতার প্রশ্ন, ‘‘তবে কি ওই নির্দিষ্ট দিনের জন্য আগাম মজুত করা হচ্ছে প্রতিষেধক? এর আগে আন্তর্জাতিক যোগ দিবসে (২১ জুন) রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে তার আগের কয়েক দিনে যেমন করা হয়েছিল!’’
ওই দিন থেকেই দেশে ১৮ বছর কিংবা তার বেশি বয়সি সকলের জন্য প্রতিষেধক নিখরচায় দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। টিকা দেওয়া হয়েছিল ৮৫ লক্ষ। তখন অভিযোগ উঠেছিল, ওই রেকর্ড গড়তে তার আগের কয়েক দিন টিকা কিছুটা কম দেওয়া হয়েছিল। রেকর্ডের পরেও ফের ঝিমিয়ে পড়েছিল তার গতি। প্রশ্ন, এ বারও তেমন হবে না তো?
বিরোধীদের দাবি, গোড়া থেকে কেন্দ্রের ভুল নীতির কারণেই টিকাকরণ হয়েছে শ্লথ গতিতে। করোনা যোদ্ধা এবং ৪৫-ঊর্ধ্বদের নিখরচায় টিকা দেওয়ার কথা শুরুতে বলা হলেও, বাকিদের জন্য ওই নীতি ঘোষণায় গড়িমসি করেছে কেন্দ্র। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে দু’ডোজ় টিকা পাওয়া মানুষ এখনও যথেষ্ট কম। তার পরেও ‘রেকর্ড’ গড়তে জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা করা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীদের অনেকে। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এ দিনও যেখানে প্রধানমন্ত্রী কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছেন, সেখানে রেকর্ডের জন্য অপেক্ষা কি সাজে?’’
কিন্তু এই সমালোচনার মুখে জন্মদিন পালনের ‘এলাহি’ পরিকল্পনায় কাটছাঁট হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্য কম। এক-দু’দিন নয়, টানা তিন সপ্তাহ ধরে মোদীর ৭১তম জন্মদিন ও প্রশাসক হিসেবে কুড়ি বছর (প্রধানমন্ত্রী ও তার আগে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মিলিয়ে) পূর্ণের বিষয়টি এক যোগে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। ওই উপলক্ষে বিভিন্ন নদীর ৭১টি স্থান পরিস্কার করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জীবন তুলে ধরতে থাকছে দেশ জুড়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। বিতরণ করা হবে পাঁচ কোটি পোস্টকার্ড। তাতে তুলে ধরা হবে মোদী সরকারের সাফল্যের খতিয়ান। করোনা-কালে ‘গরিবের মসিহা’ মোদী যে দরিদ্র মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন, তা মনে করিয়ে দিতে রেশন দোকানগুলির সামনে দেওয়া হবে তাঁর মুখের ছবি লাগানো ১৪ কোটি থলি।
বিরোধীদের কটাক্ষ, অর্থনীতি সমস্যায় জর্জরিত। লাদাখে জমি হারাতে হয়েছে চিনের কাছে। চোখ রাঙাচ্ছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। চাকরি বাড়ন্ত। তা সত্ত্বেও প্রচারে খামতি রাখতে চাইছেন না প্রধানমন্ত্রী। একে দেখনদারির তকমা দিচ্ছেন তাঁরা। এক ধাপ এগিয়ে অনেকে আবার বলছেন, ওই সমস্ত কারণে সম্প্রতি ধাক্কা খেয়েছে মোদীর জনপ্রিয়তা। চলতি মাসে একটি সংবাদমাধ্যমের করা সমীক্ষা অনুযায়ী, আগের তুলনায় তা কমেছে ২৪ শতাংশ বিন্দু। অথচ সামনেই পাঁচ রাজ্যে ভোট। তার তরী পার করতে ভরসা সেই মোদী। তাঁর জন্মদিন ঘিরে এই সমস্ত পরিকল্পনা আসলে ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টা।
দলীয় সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। তার কুড়ি দিনের মাথায়, ৭ অক্টোবর প্রশাসক হিসাবে ২০ বছর পূর্তি করতে চলেছেন মোদী। ওই দুই দিনকে জুড়ে তিন সপ্তাহ ধরে বিশেষ উদ্যাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে দল। একই সঙ্গে নদী সাফাই, রেশন বিতরণ, দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ওই দিনটিকে সেবা দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল। যা দেখে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের বক্তব্য, দেশের মানুষের ফি দিন দারিদ্র বাড়ছে আর বিজেপি সেখানে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে অর্থ উড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে কটাক্ষ করেন, মার্গদর্শক মণ্ডলিতে যেতে আর মাত্র চার বছর বাকি। সুস্থ থাকবেন। প্রসঙ্গত, বিজেপিতে অঘোষিত নীতি হল ৭৫ বছরের পরে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অবসর নিতে হয় নেতাদের। অবসর নেওয়া নেতাদের স্থান হয় মার্গদর্শক মণ্ডলিতে। যেমনটি হয়েছে লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলি মনোহর
জোশীদের ক্ষেত্রে।
প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন সংক্রান্ত তিন সপ্তাহের ওই অনুষ্ঠান সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করার জন্য চার সদস্যের একটি দল বানিয়েছে বিজেপি। দলের সদস্যরা হলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়, ডি পুরন্দেশ্বরী, বিনোদ সোনকার ও রাজকুমার চহার। আপাতত ঠিক হয়েছে, ১৭ সেপ্টেম্বর জন্মদিন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনসেবা বিষয়টি নিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠান হবে। যাতে বক্তব্য রাখবেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবকেরা। এ ছাড়া জনসেবা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় লেখা প্রকাশিত হবে। এ ছাড়া টিকাকরণ কর্মসূচি সাফল্যের সঙ্গে চলার জন্য ভিডিয়োতে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে দেখা যাবে বিজেপি কর্মীদের। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির কটাক্ষ, সমস্ত ম্যাগালোম্যানিয়াকরা এমন করে থাকে। রোম যখন পুড়ছিল তখন নীরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন। দেশের মানুষ চাকরি হারিয়ে, না খেতে পেয়ে সমস্যায়। আর সেখানে প্রধানমন্ত্রী জন্মদিন পালনে ব্যস্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy