তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকার। —ফাইল ছবি।
অদূর ভবিষ্যতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পতন অনিবার্য। তখন জাতীয় দলের ভূমিকায় আসরে নামতে হবে তৃণমূলকেই। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই প্রস্তুতিতে অনীহা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের। রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে তাঁর ইস্তফা গ্রহণ হওয়ার পরে এই মন্তব্য করলেন তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকার। তাঁর মতে, নবান্নের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয় করে পদক্ষেপ করা প্রয়োজন তৃণমূল সাংসদদের। যেমনটা নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে করে এসেছে ডিএমকে, বিজেডি এবং কেরলের বামদলগুলি। কিন্তু সেই ব্যাপারেও উদ্যোগের অভাব রয়েছে তৃণমূলের। সেই সঙ্গে জহর ঘনিষ্ঠ মহলে বলছেন, কোনও কোনও নেতার ‘অপছন্দের’ কারণে সাংসদ হওয়ার পরে প্রথম ছ’মাস আদৌ বলতেই দেওয়া হয়নি তাঁকে। পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে।
জহরের কথায়, “আমি নিজে প্রাক্তন আমলা হওয়ার কারণে কেন্দ্র-বিরোধী কোনও বক্তব্য পেশ করার বা প্রশ্ন করার আগে সরকারের পরিচিত আমলাদের কাছ থেকে তথ্য আনিয়ে নিতাম। অনেক ক্ষেত্রে সফল ভাবে আনাতে পারতাম, কখনও পারতাম না। কিন্তু সেই চেষ্টাটা কিন্তু সব সাংসদের মধ্যেই থাকা দরকার। শুধুমাত্র কাগজ পড়ে তার ভিত্তিতে প্রশ্ন করলে বিজেপিকে চেপে ধরা যাবে না।” তাঁর বক্তব্য, “শুধু রাজ্যকেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে চর্চাও খুব জরুরি। কিন্তু এ ব্যাপারেও তৃণমূল নেতৃত্বের অনীহা রয়েছে। শুধু দিল্লিভিত্তিক এক জন বা দু’জন সাংসদকে রাখলেই এই ভূমিকা পালন হয় না। তেলের দাম বাড়ানোর খেলাটা যে গুজরাতের বিশেষ তেল শোধনকারী সংস্থাকে লাভ করিয়ে দেওয়ার জন্য, সেটা বুঝতে হলে নিজেদের চর্চাকে জাতীয় স্তরে রাখতে হবে। দলীয় নেতৃত্বের এ সবের কোনও দিশা নেই, বরং উদাসীনতা রয়েছে।”
জহরের পদত্যাগপত্র হাতে নিয়ে জগদীপ ধনখড় বলেছিলেন ‘আপনি বড় আবেগপ্রবণ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন।’ সেই সঙ্গে বলেছিলেন, জহরের পদত্যাগে সংসদের ক্ষতি হয়ে গেল। জবাবে জহর বলেন, থেকেও তো প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি তিনি দিনের পর দিন। মৌখিক এবং লিখিত প্রশ্ন মিলিয়ে প্রতি অধিবেশনে ১১০টির কাছাকাছি প্রশ্ন তিনি জমা দিয়েছেন নিয়মিত। লটারিতে উঠেছে মাত্র একটি করে! এ কথাও ধনখড়কে তিনি বলেন যে, এটি কোনও আবেগ থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। রাজনীতিতে দুর্নীতি মিশে যাচ্ছে দেখে তার প্রতিবাদে একটি বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত। পরে জহর বলেন, “আসলে শাসক দল আমাদের প্রশ্নকে ভয় পেত বলেই চেপে রাখার চেষ্টা করত। একই জিনিস বারবার করা হয়েছে জয়রাম রমেশ, মনোজ ঝা, জন ব্রিট্টাসের সঙ্গেও।”
তবে শুধু শাসক দল বিজেপিই নয়, জহরের ঘনিষ্ঠ মহল তাঁর পদত্যাগ গ্রহণের দিন বলেছে, তৃণমূল রাজ্যসভা নেতৃত্বের পক্ষ থেকেও তাঁকে প্রথম ছ’মাস বলতেই দেওয়া হয়নি, যা নিয়ে ক্ষোভ ছিল সাংসদের। ২০২১ সালের ২ অগস্ট তিনি সাংসদ হিসেবে যোগদান করেন। আর প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পান পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি! তখন তৃণমূল সংসদের ভিতরেও আন্দোলনের পথে চলছে। সংসদের ৩৬ নম্বর ঘরে ২১ এর শেষে তৃণমূলী সাংসদদের ডেকে বৈঠক করেছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে জহর অভিযোগ করেন, তিনি কিছু বলারই সুযোগ পাচ্ছেন না। তাঁকে নেতৃত্ব জানান, এখন আন্দোলন চলছে, বলার সময় আসেনি। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে গোয়ার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। তিনি তখন গোয়াতেই বেশির ভাগ সময় দলের নির্বাচনী কাজ সামলাচ্ছেন। দিল্লিতে বাজেট অধিবেশনে রাজ্যসভা চালানোর দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন তৃণমূলের সচেতক সুখেন্দুশেখর রায়ের উপর। তিনি দলনেত্রীর সঙ্গে কথা বলে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে আলোচনায় জহরকে বলতে বলেন। যে হেতু সেটি তাঁর ‘মেডেন স্পিচ’, তাই সময় বেশি দেওয়া হয়, দশ মিনিটের জায়গায় চব্বিশ মিনিট বলেন জহর। বক্তৃতার শুরুতেই কিছুটা শ্লেষের সঙ্গে সে দিন তিনি বলেছিলেন, “আমি শপথগ্রহণের ষষ্ঠ মাস উদ্যাপন করছি। প্রথম বক্তৃতার জন্য ধৈর্য্য ধরে ছ’মাস অপেক্ষা করেছি।” জহর জানান, এর পরে বার বার মমতা তাঁকে বাজেট-সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথমেই বলার সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “প্রত্যেক দলের মতোই তৃণমূলেরও হিসেব করে নেওয়া উচিত, কে কিসে ভাল। আমি যতটুকু সুযোগ পেয়েছি, বিজেপির সাম্প্রদায়িক ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতির বিরুদ্ধে তথ্য-সহ বক্তব্য পেশ করেছি।”
দিল্লিতে সাংসদ হিসেবে পাওয়া বাড়ি ছাড়ার কাজ সারছেন তিনি। তার মধ্যেই আসছে জাভেদ আখতার থেকে বৃন্দা কারাট— বিভিন্ন মহলের মানুষের ফোন। তাঁরই সতীর্থ সৌগত রায় জহরকে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ বলে উল্লেখ করে ‘টিকিট না দেওয়াই উচিত ছিল’ বলে মন্তব্য করেছেন। এই পরিস্থিতিতে জহরের কিছুটা সন্তোষ তৈরি হয়েছে গত কাল সন্ধ্যায় তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া তাঁর সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্যে। রাতে ফোনে কুণাল কথা বলেন জহরর সঙ্গে। তাঁকে মনে করিয়ে দেন, ২০০৯ সালে তৃণমূল যখন একগুচ্ছ কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর পদ পায়, তাঁকে ও মুকুল রায়কে মমতা দিল্লিতে পাঠিয়ে জহরের সঙ্গে পরামর্শের নির্দেশ দেন, কোন মন্ত্রক নিলে বাংলার ভাল হবে। সেই বিষয়ে চমৎকার ব্রিফিং মুকুল, কুণালকে দিয়েছিলেন তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রকের সচিব জহর সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy