লড়াকু বৌমা তারার সঙ্গে শ্বশুর সুধন সরকার। নিজস্ব চিত্র
হাল-হকিকত জানতে আসা শহুরে লোককে দেখেই ‘হঠাৎ কলোনি’র তারা সরকার মুখের উপরে বলে দেন, ‘‘আমাদের আর সাহায্য-সহানুভূতি দরকার নেই।’’
কারবালার বসিরন বেওয়াও হয়তো বেঁচে থাকলে একই কথা বলতেন। বিস্তর লড়াই করে ছেলের জামিনের ব্যবস্থা করলেও ছেলের কারামুক্তির ক’দিন আগেই তাঁর জীবনাবসান হয়েছে।
কৃষ্ণাইয়ের ‘হঠাৎ কলোনির’ (কয়েক ঘর বাঙালি নিয়ে হঠাৎ বসতি তৈরি) সুধন সরকার বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের ডালুর বাসিন্দা। তিন বছরের কারাবাস শরীরে, মনে থাবা বসিয়েছে। ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বলেন, “ঠাকুরদার আমল থেকে আমরা ডালুর নামকরা সরকার পরিবার। বিয়ের পরে কৃষ্ণাইয়ে বসত। আর আমাকে বাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ বলে কী না, বাংলাদেশের কোথায় বাড়ি
স্বীকার করুন!”
বড় ছেলে মারা গিয়েছেন ২০১৪ সালে। তাঁর স্ত্রী তারা সংসারের কর্ত্রী। তিনি জানান, ডি-ভোটার হলেও নিয়ম করে ভোট দিতেন বাবা। তাই হাজির হননি শুনানিতেও। একতরফা রায়ে তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করে আদালত। একে স্বামী মারা গিয়েছেন, তার উপরে শ্বশুর জেলে। অথৈ জলে পড়েন তারা। বলেন, “সংসার বাঁচানোর তাগিদ আমায় শক্তি জুগিয়েছে। যখন দরকার ছিল, কাউকে পাশে পাইনি। ছেলেগুলোর পড়াশোনা টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেল। একা আদালত, জেল, এসপি অফিস, উকিলের বাড়ি চষে ফেলেছি।”
শ্বশুর বলেন, “বাবার সময়েই শিলিগুড়ি, কোচবিহারে জমি কেনা হয়। ভাইয়েরাও শিলিগুড়ির বাসিন্দা। আজ আফশোস হয়, পশ্চিমবঙ্গে চলে না গিয়ে এখানে কেন পড়ে থাকলাম। পেলাম অপমান, বিদেশি তকমা, হাজতবাস। যদি ডি-ভোটারই ছিলাম, তা হলে কেন ভোট দিতে দিল? ২০১৪ সালে ভোট দিয়ে মোদীকে ক্ষমতায় আনলাম। তার এই প্রতিদান?”
৩১ অগস্ট এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা বেরোবে। এ দিকে, তারা বাদে পরিবারের কারও নাম তালিকায় নেই। আশঙ্কা, তিন দিন পর থেকে গোটা পরিবারকেই ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে দৌড়তে হবে। তারা বলেন, “আর ভয় পাই না। হাত-পা রয়েছে। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” টিনের বাড়িতে বসে, বৌমার ভরসাতেই বুক বাঁধেন একসময়ের দুঁদে, মেজাজি ব্যবসায়ী শ্বশুরমশাই।
কারবালা বাজারের কাছে দিনমজুর ৩৯ বছরের বাচ্চু শেখের জীবনে অবশ্য এত ওঠাপড়া নেই। তাঁকে আগলে রেখেছিলেন মা। বাচ্চুর নামে বছর ছ’য়েক আগে ডি-ভোটারের নোটিস আসে। উকিল ধরেন তাঁরা। কিন্তু তিনি বাচ্চুকে নিয়ম করে শুনানিতে হাজির করাননি। ফলে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে তাঁর ঠিকানা হয় গোয়ালপাড়া জেল। শুরু হয় ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে মায়ের দৌড়োদৌড়ি। ঘরে ছেলের বউ আর চার নাতি-নাতনির পেট। উকিল-পুলিশ-আদালতে ঘুরতে ঘুরতে অসুস্থ হয়ে পড়েন বসিরন। শেষ পর্যন্ত গত জুলাইয়ে জানতে পারেন, ৩ বছরের বেশি জেলে থাকলে জামিন মিলবে। নতুন উৎসাহে নিয়ম করে পুলিশের কাছে খবর নিতে থাকেন। পুলিশ জানায়, ২ লক্ষ টাকার বন্ড আর দুই জামিনদার লাগবে। কিন্তু নিঃস্ব পরিবারের ‘গ্যারান্টার’ হতে লোক মেলে না। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধার কান্না দেখে দুই পড়শি রাজি হন। আদালতের কাজ শেষ হলেও পুলিশ জানায়, সময় লাগবে।
অগস্টের প্রথম দিকে একদিন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বসিরন। আর জ্ঞান ফেরেনি। তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দিদের প্রথম তালিকায় নামটা ছিল তাঁর ছেলের। আর জেল থেকেই মায়ের জানাজায় হাজির হতে হয় বাচ্চু শেখকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy