Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
New Criminal Laws

নয়া তিন ফৌজদারি আইন রদের দাবি ঘিরে সুর চড়ছে 

ভারতীয় দণ্ডবিধি বা আইপিসি, ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসি ও সাক্ষ্য আইন বা এভিডেন্স অ্যাক্ট ঢেলে সাজিয়ে মোদী সরকার ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ও ভারতীয় সাক্ষ্য আইন চালু করতে চলেছে।

—প্রতীকী ছবি।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪ ০৭:৪৮
Share: Save:

সোমবার থেকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ভারতীয় ন্যায় সংহিতা-সহ নতুন তিন অপরাধমূলক আইন চালু হতে চলেছে। তার আগে নতুন করে সংসদ থেকে সুপ্রিম কোর্ট, নানা স্তরে এই তিন নতুন আইন রোখার দাবি উঠল। বিরোধী শিবির থেকে প্রবীণ আইনজীবীদের দাবি, এই তিন আইনে পুলিশের হাতে অভূতপূর্ব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তার উপরে তিন আইন চালুর ফলে গোটা দেশ জুড়ে আইনি জটিলতা বেড়ে যাবে।

ভারতীয় দণ্ডবিধি বা আইপিসি, ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসি ও সাক্ষ্য আইন বা এভিডেন্স অ্যাক্ট ঢেলে সাজিয়ে মোদী সরকার ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ও ভারতীয় সাক্ষ্য আইন চালু করতে চলেছে। গত বছর সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে সংসদের দুই কক্ষে ১৪৬ জন বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করে এই তিন আইন পাশ করানো হয়েছিল। ১ জুলাই, সোমবার থেকে তিন আইন কার্যকর হবে। তার আগে সুপ্রিম কোর্টে শুক্রবার জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। দাবি, তিন আইনে আপাতত স্থগিতাদেশ জারি করে তা খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা হোক। তিন আইন আপাতত কার্যকর করার দাবি নিয়ে আলোচনা করতে শুক্রবার লোকসভায় কংগ্রেস সাংসদ ও আইনজীবী মণীশ তিওয়ারি মুলতুবি প্রস্তাবের নোটিস দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, এ নিয়ে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। আগামী সপ্তাহে বিরোধীরা ফের এই দাবি তুলবেন বলে ঠিক হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়ালকে চিঠি লিখে তিন আইন স্থগিত রাখার দাবি তুলেছেন।

কোথায় আপত্তি বিরোধী শিবির থেকে প্রবীণ সাংসদদের?

সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ের মতে, মোদী সরকারের তিন আইন হল একবিংশ শতাব্দীর রাওলাট আইন। যে আইনে ব্রিটিশ সরকারকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে যত দিন ইচ্ছে আটকে রাখা, বিনা বিচারে জেলে পুরে রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব, কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারির যুক্তি, মোদী সরকারের তিন আইনেও পুলিশ তথা রাষ্ট্রের হাতে অভূতপূর্ব ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বজিৎ দেব বলেন, “ন্যায় সংহিতার ১৫০ ও ১৫২ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের ধারা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পুরনো আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের ১২৪এ ধারায় সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করেছিল। এখন আবার সেই আইন ফিরিয়ে এনে যে কোনও ব্যক্তি বা রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যেতে পারে।” তাঁর যুক্তি, সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য ইউএপিএ-র মতো কঠোর আইন সরকারের হাতে রয়েছে। তা সত্ত্বেও ন্যায় সংহিতার ১১৩ নম্বর ধারায় সন্ত্রাসবাদের অপরাধ টেনে আনা হয়েছে। মণীশ তিওয়ারির মতে, এক দিকে রাষ্ট্রদ্রোহের কাজকর্ম কাকে বলা হবে, তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আইনে নেই। তার উপরে ইউএপিএ-র ধারা ন্যায় সংহিতায় যোগ করে অপব্যবহারের রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজিতের যুক্তি, “গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।”

সিআরপিসি-র বদলে যে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা চালু হচ্ছে, আপত্তি রয়েছে তা নিয়েও। বিশ্বজিতের মতে, এই আইনের ১৭২ নম্বর ধারায় পুলিশকে ইচ্ছে মতো গ্রেফতারের যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আর মণীশ বলছেন, ১৭৩(৩) ধারায় পুলিশ অফিসারের হাতে প্রাথমিক তদন্তের পরে এফআইআর দায়ের করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যে সব অপরাধে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল হয়, সেখানে এফআইআর দায়েরের আগে প্রাথমিক তদন্ত বাধ্যতামূলক। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে এফআইআর দায়ের করাই কঠিন হয়ে যাবে। অতি বিরল অপরাধের ক্ষেত্রেই প্রাণদণ্ডের সাজার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট, আইন কমিশন অবস্থান নিয়েছিল। মোদী সরকার তিনটি ক্ষেত্রে ফাঁসির সাজা রাখছে।

প্রবীণ আইনজীবীদের মতে, ১ জুলাই থেকে নতুন তিন আইন চালু হবে ঠিকই। কিন্তু পুরনো আইনে রুজু হওয়া বকেয়া মামলাও বিভিন্ন আদালতে ঝুলে থাকবে। ইন্দিরা জয়সিংহের মতে, দেশে একই সঙ্গে দু’টি সমান্তরাল আইনি ব্যবস্থা চালু হবে। একদিকে আইপিসি, সিআরপিসি, সাক্ষ্য আইনে বহু মামলা দেশের সর্বোচ্চ থেকে নিম্ন আদালতে ঝুলে রয়েছে। মণীশের মতে, এই সংখ্যা ৩.৪ কোটি। এর পরে নতুন তিন আইনে মামলা রুজু হওয়া শুরু হবে। ফলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে। বিশ্বজিৎ বলেন, “রবিবার রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে এফআইআর দায়ের হলে পুরনো আইনে মামলা হবে। রাত ১২টার পরে এফআইআর দায়ের হলে নতুন আইন কার্যকর হবে।” ইন্দিরার মতে, এর জেরে বকেয়া মামলার সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

দেড়শো বছরের পুরনো আইন বদলে নতুন আইন চালু করার পিছনে মোদী সরকারের যুক্তি ছিল, ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা। তাই ইংরেজি নাম বদলে ভারতীয় নামকরণ হয়েছে। বিশ্বজিতের প্রশ্ন, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের নাম কী ভাবে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা হয়? পেনালের অর্থ শাস্তি। তাই ন্যায় সংহিতার বদলে ভারতীয় অপরাধ সংহিতা নাম হওয়া উচিত ছিল। সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলাতেও এই নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়ালের যুক্তি, নতুন আইন যথেষ্ট আলোচনার পরেই তৈরি হয়েছে। সকলের জন্য সব রাজ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারির দাবি, তিন আইন ঢেলে সাজানোর কথা বললেও আইপিসি-তে মাত্র ২৪টি ধারা বাদ দিয়ে ২৩টি ধারা যোগ করা হয়েছে। সিআরপিসি-র ৯৫ শতাংশ ধারাই রেখে দেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্য আইনের ১৭০টি ধারাই নতুন আইনে রয়েছে। কিন্তু সমস্ত ধারার সংখ্যা বদলে গিয়েছে। এত দিন আইনজীবী থেকে আমজনতা এই সব ধারা সংখ্যা বললেই চিনে ফেলতেন। এখন গোটা আইনি ব্যবস্থায় বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE