দিল্লি সংঘর্ষের আক্রান্তেরা। (বাঁ দিক থেকে) মহম্মদ ভাকিল, আসগরি ও তাঁর পুত্রবধূ এবং রামসুগারত। নিজস্ব চিত্র
ঠিক এক বছর আগে, ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। উত্তর-পূর্ব দিল্লির খাজুরি খাসের শেরপুর চক। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ স্লোগান উঠল, ‘কপিল মিশ্র জিন্দাবাদ’, ‘ভারত মাতা কি জয়’। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মহম্মদ মুমতাজের ছোট্ট রেস্তরাঁর উপরে শুরু হল হামলা। প্রবল পাথর বৃষ্টির মুখে রেস্তরাঁর চেয়ার-টেবিলের আড়ালে আশ্রয় নেওয়ার সময়ই মুমতাজের কানে এসেছিল উন্মত্ত জনতার প্রশ্ন— ‘তোদের আজাদি চাই?’
এক বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি হাতড়ে মুমতাজ বলেন, ‘‘নিজে বিজেপির কর্মী ছিলাম। কিন্তু সাহায্য চাইতে গিয়ে দেখি, বিজেপি বিধায়ক মোহন সিংহ বিস্ত-ই সকলকে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘খতম করো সবকো’!’’ পুলিশের সাহায্য চাইতে মুমতাজ যখন থানার দিকে ছুটছেন, তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে তাঁর রেস্তরাঁ।
শিব বিহারের মহম্মদ ভাকিল আর দু’চোখে দেখতে পান না। উত্তর-পূর্ব দিল্লির বাসিন্দা ভাকিলের বাড়িতে হামলা হয়েছিল গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ঘরে তালা লাগিয়ে পরিবার সমেত আশ্রয় নিয়েছিলেন ছাদে। যদি কোনও ক্রমে প্রাণ বাঁচে। জীবন বেঁচেছে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁর দু’চোখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়ে গিয়েছিলেন দুষ্কৃতীরা। ওই অবস্থাতেই পুরো এক দিন লুকিয়ে থাকার পরে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে ছিলেন এক মাস। তবু দৃষ্টি ফেরেনি।
চাউমিন কিনতে বেরিয়েছিল শিব বিহারেরই রামসুগারতের মাত্র ১৫ বছরের ছেলে নীতীশ। সে আর বাড়িই ফেরেনি। রামসুগারতের কথায়, ‘‘মাথায় পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়েছিল। ছেলে ফেরেনি। এক মাস আগে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। ছেলে নাকি এমনিই রাস্তায় পড়ে মারা গিয়েছে!’’
মুস্তফাবাদের দুই ভাই হাসিম আলি ও আমির খান ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে দশটা নাগাদ গাজিয়াবাদ থেকে কাজ সেরে ফিরছিলেন। হাসিম-আমিরের মা আসগরি বলেন, ‘‘রাস্তায় ওদের বাইক আটকে, খুন করে নালায় ফেলে দেওয়া হয়। ঘরে তো আর কেউ রোজগারেরই কেউ রইল না। ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের খাওয়াবো কী?’’ আসগরির কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন মালিকা। তার আগের দিন তাঁর স্বামী মুশারফকে ঘরের খাটের তলা থেকে বার করে এনে খুন করে ওই নালাতেই ফেলে দেওয়া হয়েছিল। পরে ওই ব্রহ্মপুরী নালা থেকে উদ্ধার হয় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি খুন করে ফেলে দেওয়া ন’জনের দেহ।
সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন ও সেই আন্দোলন তুলতে বিজেপি নেতাদের হুঁশিয়ারি থেকে গত বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। কেউ চোখ খুইয়েছেন, কেউ প্রাণ। কারও বাড়ি জ্বলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুড়েছে কপালও। কেউ স্বামী হারিয়েছেন, কেউ সন্তান। বুক কিংবা মাথা ফুঁড়ে দিয়ে যাওয়ার আগে বুলেট কারও ধর্ম জিজ্ঞাসা করেনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, ‘‘রাজনীতির লাভের ঝুলি ভরতে গিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আমাদের।’’
এক বছর পরে মঙ্গলবার দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে জড়ো হয়েছিলেন হিংসায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের প্রশ্ন, বিচার কবে মিলবে? দোষীরাই বা শাস্তি পাবে কবে?
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের পাশে সিএএ-বিরোধী অবরোধ তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। অভিযোগ, তারপরেই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। এক বছর পরে কপিল বলছেন, ‘‘যা করেছিলাম, প্রয়োজনে আবার করব। কোনও অনুশোচনা নেই।’’ উল্টো দিকে, হিংসাপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়ে সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাটের অভিযোগ, ‘‘হিংসার আগে যিনি উস্কানিমূলক বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁর এমন বলার ঔদ্ধত্য থেকেই স্পষ্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তথা কেন্দ্র এই সব নেতা ও দোষীদের সুরক্ষা দিচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy