নামিবিয়ার ভূমিপুত্র। ছবি: পিটিআই
কপিকলের চাকা ঘুরতেই ভীরু ভীরু চোখে খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছিল নামিবিয়ার যে ভূমিপুত্রেরা, সরকারি বিজ্ঞপ্তি বলছে— দেশ থেকে লুপ্ত হয়ে যাওয়া চিতাকুলে তারাই নতুন করে প্রদীপ জ্বালবে!
প্রধানমন্ত্রী তাঁর জন্মদিনে মধ্যপ্রদেশের অভয়ারণ্যে সেই আটটি আফ্রিকার চিতার (অ্যাসিনোনিক্স জুবাটুস জুবাটুস) পুনর্ভিষেক ঘটিয়ে বলেছেন, “আগে পায়রা ওড়াতাম এখন চিতা ছাড়ি!” সঙ্গে ছিল ঘোষণা— “এই বিলুপ্ত প্রাণীটিকে অন্য দেশ থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা এ যাবত কোনও সরকারই করেনি।“ তিনি করেছেন ঠিকই, তবে তাঁর এই সাফল্যে হাততালির রেশ থিতিয়ে আসার আগেই দেশের প্রাণী বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ পাল্টা একটি প্রশ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছেন— বিলুপ্ত ভারতীয় চিতার (অ্যাসিনোনিক্স জুবাটুস ভেনাটিকাস) পুনর্ভিষেক কী করে আফ্রিকার চিতাদের হাত ধরে সম্ভব? বিরোধীদের দাবি, ‘একটি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকে দেশের মাটিতে ছেড়ে পুনঃস্থাপনের দাবি কি নৈতিক? এ তো বুলেট ট্রেনের মতো নিতান্তই গিমিক!’
এই নৈতিকতার প্রশ্নেই, প্রাণী গবেষণায় বিশ্ব সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজ়ারভেশন অব নেচার’-এর (আইইউসিএন) বিধিও এ ক্ষেত্রে বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ভিন দেশের কোনও বিশেষ প্রজাতির প্রাণীকে নিজের দেশে পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা অনুচিৎ। তাই ‘প্রোজেক্ট চিতা’ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এ দেশে চিতার দেখা শেষবার মিলেছিল ১৯৪৮-এ। মধ্যপ্রদেশের উত্তরাংশে সরগুজার মহারাজা রামানুজ প্রতাপ সিংদেও মৃগয়ায় বেরিয়ে ভারতীয় চিতার শেষ তিন বংশধরকে হাতির হাওদা থেকেই নিকেশ করেছিলেন গুলিতে। তারপর আর খোঁজ না মেলায় ১৯৫২য় ভারতীয় চিতার উপরে অবলুপ্তির সিলমোহর পড়ে গিয়েছিল প্রায় পাকাপাকি ভাবে।
ধীরে ধীরে বইয়ের পাতায় আবছা হয়ে গিয়েছিল তাদের স্মৃতি। সেই আলোছায়া স্মৃতি ডানা না মেললেও একটা ইচ্ছে অবশ্য দানা বাঁধতে শুরু করেছিল প্রায় আড়াই দশক আগে। নব্বই দশকের প্রান্তে, সদ্য গড়ে ওঠা হায়দরাবাদের ‘ল্যাবরেটরি ফর দ্য কনজ়ারভেশন অব এনডেঞ্জার স্পিসিস’ (এলসিইএস)-এর কতিপয় উৎসাহী গবেষক দিল্লির দরবারে প্রস্তাব দিয়েছিলেন , দেশের জল-জঙ্গল থেকে মুছে যাওয়া পশুপাখিদের ফিরিয়ে আনলে কেমন হয়? তালিকায় ছিল এশীয় চিতা। তবে, সে সময়ে ঘনঘন সরকার বদলের ধাক্কায় ‘অজরুরি’ হিসাবে গণ্য হয়ে ফাইলবন্দি হয়েছিল সেই প্রস্তাব। সেই প্রস্তাবের ফাইল ২০০৪ সাল নাগাদ খোলা হলেও ইন্দোনেশীয় সরকার জানিয়ে দিয়েছিল পিগমি হাতি কিংবা জাভা দ্বীপের খুদে গন্ডার বিনিময় করার কোনও ইচ্ছে তাদের নেই।
ভারতীয় চিতার একমাত্র স্বজাতিদের বাস রয়েছে ইরানে কাইজ়েলকুম মরুঅঞ্চলে। কিন্তু টিমটিম করে জেগে থাকা সেই খান পঞ্চাশ চিতার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে তাদের আপত্তিও সাফ জানিয়েছিল ইরান সরকার। ফলে ফাইলের উপরে ফের জমতে শুরু করেছিল ধুলো। ভাবনা-চিন্তাটা মাথা চাড়া দিয়েছিল ২০০৯-এ। তড়িঘড়ি মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানকেই বেছে নেওয়া হয় আসন্ন চিতাকুলের নব্য বাসভূমি হিসেবে। কিন্তু কেন?
আফ্রিকার চিতা পুনর্ভিষেকের প্রশ্নে আপত্তি জানিয়ে আসা দেশের বিশিষ্ট বাঘ-বিশেষজ্ঞ বল্মীক থাপার বলছেন, ‘‘এই পরীক্ষাটা ভয়ানক দুঃখজনক পরিণতি পেতে চলেছে বলেই মনে করি। আফ্রিকার অসম্ভব সুন্দর ওই প্রাণীগুলিকে কুনোর মতো অভয়ারণ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে, যেখানে তাদের শিকার করার মতো কী আছে! নেই তাদের পরিচিত সাভানা, ওদের কথা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে।’’
কুনোর ঘাসজমি যে চিতাদের বসবাসের পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয়, তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন দেশের আর এক বাঘ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। তিনি বলছেন, ‘‘সাকুল্যে ৭৪০ বর্গ কিলোমিটারের কুনো অভয়ারণ্য। প্রতিটি চিতার নিজস্ব বিচরণ এলাকা থাকে যা অন্তত ১০০ বর্গ কিলোমিটার। কুনোয় তা হলে ক’টা চিতা থাকবে, সাতটি?’’ আফ্রিকার চিতার স্বভাব নিয়ে দীর্ঘ সতেরো বছরের অভিজ্ঞতা যাঁর সেই আর্থার জেফার্সন ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকার চিতাদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ইম্পালা, জেমবাক। ভারতের জঙ্গলে নীলগাই, সম্বরের মতো বড় হরিণ কি নামিবিয়ার চিতারা শিকার করতে পারবে? তা ছাড়া, ভারতীয় জঙ্গলে বাঘ কিংবা চিতাবাঘের (লেপার্ড) মতো প্রাণীরা রয়েছে। যারা চিতার বড় শত্রু।’’ বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুন্ডুর মন্তব্য, ‘‘টাকাটা দেশের বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণে ব্যয় করলে হত না!’’
দেশের বনমন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘এ দেশের প্রতিকুলতার সঙ্গে নামিবিয়ার অতিথিরা মানিয়ে নিলে ভাল, না হলে নিছক সাফারি পার্ক করেই রেখে দেওয়া হবে ওদের।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy