Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
Duronto express

একের পর এক কামরা দখল পুণে থেকে হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেসে, যাত্রীহেনস্থায় ‘হেলদোল নেই’ রেলের

সারা রাত তাণ্ডব চালিয়ে ভোর ৪টের সময় নাগপুর স্টেশনে নেমে যায় মানুষগুলো। তার পরে আরপিএফের তরফে ফোন আসে অভিযোগকারীর কাছে। কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা পরে তৎপরতা কেন? তার উত্তর মেলেনি।

—ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:২৪
Share: Save:

রাতের দুরন্ত এক্সপ্রেস। এসি কামরার প্রত্যেকটিতেই একে একে নিভতে শুরু করেছে আলো। ঘুমোনোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিলেন যাত্রীরা। ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। আর এক ঝটকায় রাতের ঘুম কেড়ে নিল হাওড়ামুখী দুরন্ত এক্সপ্রেসের যাত্রীদের।

আতঙ্কে কাঁটা হয়ে তাঁরা দেখলেন, তাঁদেরই টিকিট কেটে সংরক্ষণ করা কামরায় তাঁদেরকেই আসন থেকে সরিয়ে জবরদখল নিচ্ছেন কিছু মানুষ। সংখ্যায় তাঁরা এতটাই বেশি, যে প্রতিবাদ করে লাভ নেই। হাতে লাঠিসোঁটা। মদ্যপানের প্রমাণও স্পষ্ট। তাল জ্ঞান হারিয়ে কামরার কাচের জানলাতে লাঠি চালিয়ে ভাঙছেনও কেউ কেউ। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন পুণে থেকে হাওড়াগামী দুরন্ত এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। আর এই সব যখন চলছে, তখন সব জেনেও নির্বিকার ছিল রেল। দুরন্তর যাত্রীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ।

সোমবার বিকেল ৩টে ১৫ মিনিটে পুণে থেকে ছেড়েছিল ১২২২১ পুণে হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেস। ঠিক ৯টা স্টেশনে থেমে ২৯ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার রাতে যাত্রীদের নিয়ে হাওড়ায় পৌঁছনোর কথা তার। তার আগে সোমবার রাতেই ঘটনার শুরু।

রাত ১০টা ৪০ মিনিট নাগাদ পুণে-হাওড়া রুটের তৃতীয় স্টেশনে এসে পৌঁছয় দুরন্ত। স্টেশনের নাম ভুসওয়ল। সাধারণত মাঝের স্টেশনগুলিতে বেশি যাত্রী ওঠেন না। কিন্তু পুণে-হাওড়া দুরন্তর যাত্রীরা ঘুম চোখে দেখলেন, ভুসওয়ল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সারি সারি মাথা। প্রত্যেকটা কামরার বাইরে গড়ে নাহক শ’পাঁচেক করে মানুষের ভিড়। ট্রেন থামতে না থামতেই দুরন্তর দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে স্রোতের মতো তাঁরা ঢুকতে শুরু করলেন সংরক্ষিত বাতানুকূল কামরার ভিতরে।

দুরন্তের বাতানুকূল কামরায় তখন থিক থিকে ভিড়।

দুরন্তের বাতানুকূল কামরায় তখন থিক থিকে ভিড়। — নিজস্ব চিত্র

ওই ট্রেনেরই ‘বি ফোর’ কামরায় পরিবার নিয়ে কলকাতায় ফিরছিলেন কাঞ্চন দাস। সঙ্গে ছিল সাত বছরের সন্তান এবং স্ত্রী রেশমি চৌধুরী। রেশমি বলেন, ‘‘৬০-৬৫ জনের থাকার কামরা। সেখানে ঢুকে পড়েন প্রায় হাজার খানেক মানুষ। তাঁদের জামাকাপড় অপরিচ্ছন্ন। আচরণও খারাপ। আমাদের আসন থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওরা আমাদের আসনে বসে পড়ে। আমাদের জলের বোতল, খাবার, হাতের ব্যাগ কেড়ে নেয়। এমনকি, রেলের দেওয়া কম্বল, চাদর, বালিশও নিয়ে নেয়।’’ বাতানুকূল কামরায় জানলা খোলার উপায় নেই। একসঙ্গে এত লোক ঢুকে পড়ায় এসি কাজ করা বন্ধ করে দেয়, অনেকেরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয়। রেশমি জানিয়েছেন, তিনি অ্যাজ়মা রোগী। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাঁরও। তবে জবরদখলকারীদের সে কথা বলে বুঝিয়েও লাভ হয়নি। তবে তার থেকেও বড় কথা, এই বিপদে কাউকে পাশে পাননি ওই দুরন্তের যাত্রীরা।

খোদ ট্রেনের টিকিট পরীক্ষকই ভিড়ের চোটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলছিলেন দরজা ধরে। হাজার হাজার মানুষের ভিড় পেরিয়ে যাত্রীদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষেও। নিরূপায় যাত্রীরা শেষে অনলাইনে রেলের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। অভিযোগ জানিয়েছিলেন আরপিএফের হেল্পলাইন নম্বরেও। কিন্তু বার বার অভিযোগ বাতিল হয়েছে। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সাহায্য করা আপাতত সম্ভব নয়। এমনকি, যে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে সমস্যার কথা পোস্ট করা মাত্র সমাধান করা হয় বলে দাবি করা হয়, সেই এক্সে সমস্যার কথা জানিয়েও কোনও সাহায্য আসেনি। রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টে পর্যন্ত না ঘুমিয়েও দুঃস্বপ্ন দেখেছেন ১২২২১ পুণে-হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেসের যাত্রীরা।

হাওড়ার টিটিই এস কে উপাধ্যায় ছিলেন ট্রেনের টিকিট পরীক্ষার দায়িত্বে। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ওই পাঁচটি ঘণ্টা আতঙ্কে কেটেছে তাঁরও। দুরন্তয় চার দিন করে ডিউটি থাকে তাঁর। যে ট্রেনটি হাওড়া থেকে পুণে গিয়েছে সেই ট্রেনটি নিয়েই আবার পুণে থেকে হাওড়া ফেরা। উৎসবের মরশুমে ভর্তি ট্রেনে এই দায়িত্বে চার জন টিকিট পরীক্ষকের থাকার কথা। যদিও উপাধ্যায় জানাচ্ছেন সেই চার জনের কাজ সামলাতে হয় দু’জনকে। সোমবারও তিনি সেই দায়িত্ব পালন করছিলেন। ট্রেনে কোনও নিরাপত্তারক্ষী ছিল না। আচমকাই এ ভাবে জনস্রোত ঢুকতে দেখে কিছু করতে পারেননি তিনিও। উল্টে নিজেও ওই ভিড়ের শিকার হন।

তিল ধারণের জায়গা নেই ট্রেনের ভিতরে। বাইরেও দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা ধরা পড়ল জানলা দিয়ে।

তিল ধারণের জায়গা নেই ট্রেনের ভিতরে। বাইরেও দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা ধরা পড়ল জানলা দিয়ে। — নিজস্ব চিত্র।

টিকিট পরীক্ষকের কথায়, ‘‘তখন দরজায় দুমদাম আওয়াজ। বিভিন্ন স্টেশন থেকে লোক উঠতে পারে বলে, বাইরে থেকে খোলা যায় এমন ভাবেই বন্ধ করা ছিল অধিকাংশ দরজা। দেখি সেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকছে কাতারে কাতারে মানুষ। যে দরজা খোলা যাচ্ছে না, তাতে সজোরে আঘাত করছিল ওরা।’’

কী ভাবে টিকিট ছাড়াই দুরন্তের মতো ট্রেনে এত মানুষ উঠলেন, তা স্পষ্ট নয় টিকিট পরীক্ষকের কাছেও। তবে তিনি আরও বিস্মিত রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সময়ে সাহায্য না এসে পৌঁছনোয়। উপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমি কন্ট্রোল রুমে ফোন করেছিলাম। বার বার চেন টানা হচ্ছিল। ট্রেন বেশ কয়েক বার দাঁড়িয়েও পরছিল। আরপিএফ পাঠানোর অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল ওঁরা যখন এল, তখন কিছুই করল না!’’

আরপিএফ এসে কী করেছে, তা জানিয়েছেন খোদ টিকিট পরীক্ষকই। তিনি বলেছেন, ‘‘ওরা শুধু এসে বাইরে থেকে লাঠি দেখিয়ে চলে গেল। ওই লোকগুলোকে বলল ট্রেন থেকে নেমে যেতে। আর বলল ট্রেন চালাতে। ব্যস্, এটুকুই।’’ কন্ট্রোল রুমে আর ফোন করা হয়নি? জবাবে উপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘সে-ও করা হয়েছিল। কিন্তু তারা ব্যাপারটা দেখছেন বলে জানালেও আর কোনও ফোন আসেনি তাদের তরফে।’’

ওই ট্রেনেই কলকাতায় আসছিলেন শেখ সাজিদ। আসছিলেন সিন্টু কুণ্ডুও। সিন্টুর মতে, ‘‘প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে গাফিলতি করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ভুসওয়ল স্টেশনে যখন দাঁড়িয়েছিলাম তখনই দুরন্তর আসার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। তাদের ওখানে কেন দাঁড়াতে দেওয়া হল। কেনই বা ওঠার সময় স্টেশনে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের আটকালেন না সেটাও ভাবার।’’

তবে রেল একেবারে যোগাযোগ করেনি তা নয়। কাঞ্চনরা জানাচ্ছেন, সারারাত তাণ্ডব চালিয়ে ভোর চারটের সময় নাগপুর স্টেশনে নেমে যায় ওই ভিড়টা। তার পর আরপিএফের তরফে ফোন আসে অভিযোগকারীদের কাছে। সারা রাতের অভিজ্ঞতার পর স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলেন যাত্রীরা। আরপিএফকে তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, গত পাঁচ ঘণ্টা ধরে তারা কোনও তৎপরতা দেখাননি কেন? কেনই বা নাগপুর স্টেশনে এই জবরদখলকারীদর জন্য কোনও বাহিনী পাঠানো হয়নি? কেন এ ভাবে বেআইনি কাজ করেও পার পেয়ে গেল ওই মানুষগুলো? আরপিএফ অবশ্য এক কথায় জানিয়েছে, ‘‘দুরন্তর মতো ট্রেন মাঝরাস্তায় থামানোর নিয়ম নেই।’’ কিন্তু ট্রেনে যদি হামলা হয়, যদি কারও প্রাণসংশয় হত? তা হলে? জবাব মেলেনি রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক আদিত্য কুমার চৌধুরীকে বহু চেষ্টায় যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও তিনি ঘটনাটি শুনে বলেন, ‘‘ভুসওয়ল স্টেশনের ঘটনা মানে মধ্য রেলওয়ের অধীন। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।’’ তবে মধ্য রেলওয়ের তরফেও শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।

ওই জবরদখলকারীরা আসলে কারা? কেনই বা ওই ট্রেনে ওই ভাবে উঠেছিলেন? তার জবাব খুঁজতে গিয়ে যাত্রীরা জেনেছেন, নাগপুরে একটি জনসভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন এঁরা। তার জন্যই উঠেছিলেন সংরক্ষিত দুরন্তের কামরায়। কিন্তু সেখানে উঠে যাত্রীদের উপর অত্যাচার, রেলের সম্পত্তি লুট, প্যান্ট্রি কারের খাবার খেয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটালেন কেন? তার জবাব মেলেনি। তবে একটা আশঙ্কা এখনও রয়েছে। হাওড়ার ওই টিকিট পরীক্ষকের আশঙ্কা, এই ট্রেন হাওড়া হয়ে আবার ফিরবে পুণায়। তখন ফিরতি পথের যাত্রীরাও এই একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারেন। আপাতত সেটুকু সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা হলেও হয়। একটা দুঃস্বপ্নের রাত কাটানোর পর আরও একটি দুঃস্বপ্ন দেখতে চান না তাঁরা।

অন্য বিষয়গুলি:

Duronto express
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy