Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
এখনও জানা নেই শান্তির সূত্র
Manipur Violence

মণিপুরে ৮০ দিনব্যাপী হিংসা থামবে কী ভাবে? উত্তর নেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে

মে মাসের গোড়া থেকে মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে কুকিদের সংঘাত চলছে। সরকারি হিসাবেই দেড়শোর কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ছয় হাজারের বেশি এফআইআর দায়ের হয়েছে।

An image of Manipur Violence

মণিপুরের অশান্ত পরিস্থিতি। —ফাইল চিত্র।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৩ ০৪:৩৬
Share: Save:

মণিপুরের হিংসা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে মুখ খুলতে রাজি হবেন কি না, সেটা পরের প্রশ্ন। বিজেপি-শাসিত মণিপুরে গত ৮০ দিন ধরে চলতে থাকা হিংসা কী ভাবে থামবে, সেটা নিয়েই এখনও অন্ধকারে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেও এর কোনও উত্তর নেই। মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও সংঘাত যে জায়গায় পৌঁছেছে, তা থামাবার কোনও সমাধানসূত্র এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের কেউ বলতে পারছেন না।

আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী মণিপুরের অশান্ত পরিস্থিতি ক্রমশ মোদী সরকারের অন্দরমহলে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। কারণ মোদী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন, সামরিক বাহিনী নামিয়ে দুই জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ঠেকানো মুশকিল। অথচ রাজনৈতিক প্রচেষ্টাতেও সাফল্য মিলছে না। খোদ অমিত শাহের মণিপুর সফরের পরেও হিংসা অব্যাহত।

কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রের বক্তব্য, রাজনৈতিক ভাবে মণিপুরের নারী নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে অন্য রাজ্যের নারী নির্যাতনকে তুলনা করে দেখানো যেতে পারে। কিন্তু মণিপুরের অশান্তি শুধুমাত্র একটি গণধর্ষণের ঘটনা নয়। সীমান্তবর্তী একটি রাজ্যে তিন মাস ধরে অশান্তি চললে, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে জাতীয় নিরাপত্তাতেও তার প্রভাব পড়ে। আজ মোদী সরকারের মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি নিজেই তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর মন্তব্য, “মণিপুরের বিষয়টি শুধু স্পর্শকাতর নয়। জাতীয় নিরাপত্তার উপরেও এর প্রভাব রয়েছে। বিরোধী শিবিরের নেতারাও তা জানেন।”

মে মাসের গোড়া থেকে মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে কুকিদের সংঘাত চলছে। সরকারি হিসাবেই দেড়শোর কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ছয় হাজারের বেশি এফআইআর দায়ের হয়েছে। খুনের মামলা ৭০টিরও বেশি। অসংখ্য গণধর্ষণ-সহ নারী নির্যাতনের এফআইআর দায়ের হয়েছে। গোটা রাজ্য কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত।মেইতেই অধ্যুষিত এলাকায় কুকিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কুকিদের এলাকায় মেইতেইরা গেলে প্রাণ হাতে করে ফেরা মুশকিল। এখন এমনই পরিস্থিতি যে, বিজেপির কুকি সম্প্রদায়ের বিধায়কেরা দাবি তুলেছেন, কুকি অধ্যুষিত এলাকাগুলি মণিপুর থেকে ভেঙে আলাদা রাজ্য গঠন করা হোক। বা এই এলাকাগুলি মিজোরামের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হোক। ওই এলাকাগুলিতে স্বশাসিত পরিষদ গঠন করা হোক।

কেন্দ্রীয় সরকারের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “মণিপুরের দুই জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন ও বিদ্বেষ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, সেনাবাহিনী নামিয়ে এই অশান্তি ঠেকানো মুশকিল। এমনিতেই মণিপুরে যথেষ্ট বাহিনী রয়েছে। রাজনৈতিক সমাধানই একমাত্র উপায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজে মণিপুরে গিয়ে ঘুরে এসেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই মণিপুরে গিয়ে বহু দিন থেকেছেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মুশকিল হল, কোনও রাজনৈতিক প্রচেষ্টাতেই লাভ হচ্ছে না।”

প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের বক্তব্য, মণিপুরে মেইতেই, কুকি, নাগাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রয়োজন। প্রতিটি সম্প্রদায়ের একে অন্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে। ভুল, ঠিক যে-ই হোক না কেন, একসময় সবাইকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছতে হবে। তার আগে পারস্পরিক অভিযোগ, হিংসা থামাতে হবে। চিদম্বরমের যুক্তি, “এর জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসন প্রয়োজন। সে কারণেই রাষ্ট্রপতি শাসনের প্রয়োজন।” কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের আমলারা বলছেন, মণিপুর বিরোধী শাসিত রাজ্য হলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার কথা ভাবা হত। বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বিজেপিরই কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করলে, তা মোদী-শাহের দলের চূড়ান্ত ব্যর্থতা বলে প্রমাণিত হবে। মোদী কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিজেপি সরকার থাকার সুবিধা বোঝাতে যে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর তত্ত্ব প্রচার করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তারা বলছেন, আরও বাহিনী পাঠিয়ে মণিপুরে লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ মণিপুরে এখনই সেনা, আসাম রাইফেলস, আধাসেনা মিলে প্রায় এক লক্ষ জওয়ান রয়েছেন। মণিপুরের জনসংখ্যা মাত্রই ৩২ লক্ষ। তার সঙ্গে রয়েছে রাজ্যের পুলিশ বাহিনী। কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, রাজ্যের পুলিশ বাহিনীও মেইতেই, কুকিতে বিভাজিত। পুলিশ বাহিনীর মেইতেই ও কুকি কর্মীরা একে অন্যের এলাকায় ঢুকতে পারছেন না।

কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে এন বীরেন সিংহকে সরানো হোক। তিনিএক বার পদত্যাগ করতে গিয়েও সরে এসেছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেদের ব্যর্থতা লুকোতে বীরেনকে আড়াল করছেন। বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, মণিপুরের মেইতেই ও কুকিদের পুরনো বিবাদ মিটিয়ে তাঁদের এককাট্টা করতে মেইতেই অধ্যুষিত মণিপুরের সমতল ও কুকি অধ্যুষিত পার্বত্য এলাকার মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে বীরেনই ছিলেন সেরা বাজি। তিনি অনেকখানি সফলও হয়েছিলেন। এখন বীরেনই ‘বিভাজনের কারিগর’ হিসেবে খলনায়ক হয়ে উঠেছেন। তাঁর বদলে অন্য কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলে তিনি এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিজেপিরই বিধায়ক পাওলিয়েনলাল হাওকিপের অভিযোগ, “বীরেন সিংহ সরকার কুকর্মে মদত দিচ্ছে বলেই হিংসা থামছে না। জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসাকে মুখ্যমন্ত্রী মাদক মাফিয়া, সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান হিসেবে তুলে ধরেছেন। কুকি-জো-দের বাড়িঘর কট্টরবাদী মেইতেইরা পুড়িয়ে দিলে তাতে রাজ্য পুলিশ মদত দিয়েছে। এর পিছনে যুক্তি হিসেবে কুকিদের সবাইকে মাদক মাফিয়া হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE