পুরীর জগন্নাথ মন্দির। —ফাইল চিত্র।
গর্ভগৃহের বাঁ পাশে সেই অন্ধকার কুঠুরিতে নাকি বিষধর সাপের আড়ত। তারাই পাহারা দিচ্ছে জগন্নাথদেবের মণিমুক্তো, হিরে-জহরত। ছ’বছর আগে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল, সেই কুঠুরি পরিদর্শন করতে সাপের ওঝাদেরও সঙ্গে করে নিয়ে যায় হাই কোর্ট নিযুক্ত কমিটি। স্নান করে শুদ্ধ হয়ে কোমরে গামছামাত্র সম্বল অবস্থায় বাহির ভান্ডার থেকে ভিতর ভান্ডারের দুয়ারে যান এএসআই-এর স্থাপত্যবিদ, সরকারি কর্তা থেকে সেবায়েতরা। চাবি ‘হারানোয়’ ভান্ডার খোলা যায়নি। জগন্নাথদেবের মণিমুক্তোর দিকে স্থির চোখে চাইলে নাকি লোকে অন্ধ হয়ে যায়। সার্চলাইট জ্বেলে ভিতর ভান্ডারের জাফরি-কাটা দরজায় জোরালো আলো ফেলে ভয়ে-ভয়ে তাকিয়েই কেটে পড়েন পরিদর্শনকারীরা।
হাল আমলে জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভান্ডার রহস্য তাই আরও গাঢ় হয়েছে। ওড়িশার সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটে রত্নভান্ডারের চাবি-অন্তর্ধানকেই তাস করেছিল বিজেপি। বাহির ভান্ডারে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠানের বেশভূষা, গয়নাগাঁটি সামলে রাখতেই তিন গোছা চাবির ব্যবস্থা। শ্রী মন্দিরের প্রধান সেবায়েত গজপতি রাজা, দেশের আইনবলে ১৯৬০ থেকে মন্দিরের স্বত্বাধিকারী ওড়িশা প্রশাসন বা জেলার কালেক্টর এবং ঠাকুরের সাজগোজের সেবায়েত ‘ভান্ডার মেকাপ’-এর দায়িত্বে এই তিন আলাদা চাবি থাকে। ভিতর ভান্ডারের অষ্টধাতুর চাবিটি থাকার কথা শুধুমাত্র পুরীর কালেক্টরের কাছে। ভক্ত পরিমণ্ডল মানে, পুরাসামগ্রী সেই চাবিটুকুই অমূল্য সম্পদ। চাবি হারানোর শোক জগন্নাথ-পরম্পরায় বিশ্বাসীদের বুকে তিরের মতো বিঁধে। নবীন পট্টনায়কের ঘনিষ্ঠ দক্ষিণী আমলা ভি কে পান্ডিয়ানকে ঠুকে বিজেপি জোরালো প্রচার চালিয়েছিল, ভিতর ভান্ডারের সেই চাবি বুঝি তামিলনাডুতেই চলে গিয়েছে।
চাবি হারানোর পরে রত্নভান্ডার আর খোলা হয়নি। ১৯৭৮ সালের ১৩ মে থেকে ২৩ জুলাই শেষ বার রত্নভান্ডারের সম্পদের খতিয়ান নেওয়া হয়। প্রভু জগন্নাথের সম্পত্তিতে হাত পড়ার শঙ্কা চাউর করে এ বছর ভোটপ্রচারে ক্ষমতায় এলে আবার রত্নভান্ডারের সম্পদ জরিপের আশ্বাস দিয়েছে বিজেপি। এ বার তাদের কথা রাখার সময়।
ওড়িশার সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজেপি সরকার নিযুক্ত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ১৪ জুলাই ভিতর ভান্ডার খুলে দেখার কথা বলেছে। তাতে নতুন করে তোলপাড় চলছে উৎকলভূমিতে। কারণ, ১৫ জুলাই হল উল্টোরথ বা বাহুড়া যাত্রা। এর পরে নানা আচার-অনুষ্ঠান শেষে ১৯ জুলাই নীলাদ্রী বিজে। সেদিনই বিগ্রহ ত্রয়ীর মন্দিরে ফেরা। এত কিছুর ঝক্কির মধ্যে রত্নভান্ডার খুলে সম্পত্তির খতিয়ান নেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। এর কারণ, ভিতর ভান্ডার খুললে সম্পদের খতিয়ান নিতে কয়েক মাস লাগার কথা। তা ছাড়া, ভিতর ভান্ডারের দেওয়ালে ফাটল ধরে দ্বাদশ শতকীয় মন্দিরটির অবস্থাই সঙ্গিন বলে জানিয়েছিল পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ। রুরকির সেন্ট্রাল বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং আইআইটি চেন্নাইয়ের স্থাপত্যবিদেরা এসে তখনই শ্রী মন্দিরের অবস্থা সরেজমিনে
দেখে যান।
ওড়িশার ইনট্যাকের সভাপতি তথা ঐতিহ্য রক্ষাকর্মী অনিল ধীর ক্ষুব্ধ, ‘‘১৯৭৮এর নথির সঙ্গে মিলিয়ে রত্নভান্ডারের সম্পদ খতিয়ে দেখার দেখার থেকেও সমস্যা গভীরে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, দেওয়ালের ফাটলে ক্ষতবিক্ষত, রত্নভান্ডারের খুপরি না-সারালে গর্ভগৃহই ধসে পড়বে।’’ শ্রী মন্দিরের সেবায়েতকুল থেকে প্রশাসকেরা ওয়াকিবহাল, রত্নভান্ডার সারাতে বা সম্পদের খতিয়ান নিতে সব মণিমুক্তো কোনও নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে। সেটা কোথায়? কী ভাবে? কত দিনের জন্য? এত শত প্রশ্নই জগন্নাথের ভক্তদের তাড়া করে চলেছে। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy