মহুয়া মৈত্র। ছবি: পিটিআই।
শুধু লোকসভা থেকে বহিষ্কার নয়, মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে লোকসভার এথিক্স কমিটি দ্বিমুখী তদন্তেরও সুপারিশ করেছে। তার কারণ, প্রথমত, মহুয়া তাঁর হয়ে লোকসভায় প্রশ্ন জমা দিতে দর্শন হীরানন্দানিকে সংসদের পোর্টালের লগইন আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তায় এর প্রভাব নিয়ে এথিক্স কমিটিকে রিপোর্ট দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। অন্য কাউকে এই ভাবে লগইন আইডি, পাসওয়ার্ড দেওয়াকে ‘আপত্তিজনক’, ‘অনৈতিক’, ‘জঘন্য’ ও ‘অপরাধমূলক কাজ’ আখ্যা দিয়ে এথিক্স কমিটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘কঠোর, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক’ তদন্তের সুপারিশ করেছে। দ্বিতীয় কারণ, হীরানন্দানির থেকে মহুয়ার নগদ, উপহার, নানা সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে দু’জনের মধ্যে ‘টাকার লেনদেন’ বা ‘মানি ট্রেল’-এরও একই রকম তদন্তের সুপারিশ করেছে কমিটি। কারণ কমিটির কাছে সেই তদন্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই।
বিরোধী শিবির মনে করছে, ‘ঘুষ নিয়ে প্রশ্ন’ করার অভিযোগে লোকসভা থেকে বহিষ্কারের পরে মহুয়ার বিরুদ্ধে সিবিআই ও ইডি-র তদন্তও শুরু হবে। এথিক্স কমিটির রিপোর্ট সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। লোকপালের সুপারিশের ভিত্তিতে সিবিআই আগেই এফআইআর দায়ের করার আগে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে বলে সূত্রের খবর। বিরোধী শিবিরের মতে, যে ভাবে এথিক্স কমিটি ‘মানি ট্রেল’ বা টাকার হাতবদলের তদন্তের কথা বলেছে, তাতে ইডি-ও এই তদন্তে সিবিআইয়ের দোসর হবে। সে ক্ষেত্রে মহুয়াকে বিব্রত করতে আইন-আদালতের মামলাতেও জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হবে।
উল্টো দিকে, মহুয়ার সামনে তাঁকে সংসদ থেকে বহিষ্কারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার রাস্তা খোলা রয়েছে বলে বিরোধী শিবির মনে করছে। এথিক্স কমিটি যে প্রক্রিয়ায় আজ মহুয়ার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করেছে, যে ভাবে তাঁকে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাতে একাধিক ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে হয়ে বলে আজ লোকসভাতেই সওয়াল করেছেন তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারির মতো পেশাদার আইনজীবীরা। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তাঁর নিজের বক্তব্য জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি। মহুয়ার বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ তুলেছিলেন, মহুয়াকে তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়নি এথিক্স কমিটি। পরে কল্যাণ বলেন, ‘‘সংসদের কাউকে বহিষ্কার করার ক্ষমতা নেই। শুধু মাত্র সাংসদ পদ খারিজের অধিকার রয়েছে। কারও সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হলে, আইন মানা না হলে সুপ্রিম কোর্ট সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’’ তৃণমূল সূত্রের খবর, মহুয়া সুপ্রিম কোর্টে যাবেন কি না, তা নিয়ে তিনিই ভাবনাচিন্তা করবেন।
আজ লোকসভায় এথিক্স কমিটির যে ৪৯৫ পৃষ্ঠার রিপোর্ট পেশ হয়েছে, তাতে মহুয়া কমিটির সামনে কী বলছেন, তার সমস্ত তথ্য রয়েছে। তাঁর হয়ে প্রশ্ন জমা করার জন্য দর্শন হীরানন্দানিকে সংসদের পোর্টালের লগইন আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়ে দেওয়া, তার বিনিময়ে ঘুষ-উপহার নেওয়ার অভিযোগ নিয়ে মহুয়া কমিটির সামনে যুক্তি দিয়েছিলেন, কেউ কাউকে উপহার দিতে পারেন। হীরানন্দানি তাঁর বন্ধু ছিলেন। বন্ধু হিসেবে তিনি মুম্বই গেলে তিনি গাড়ি পাঠিয়েছেন। উপহার দিয়েছেন। সেটাকে ঘুষ বলা যায় না। নগদ টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। গোটা অভিযোগটাই তাঁর ‘প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড’ জয় অনন্ত দেহাদ্রাইয়ের। যাঁর সঙ্গে তিক্ততা রয়েছে। সেটা চেপে গিয়ে দেহাদ্রাইকে শুধু মাত্র সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
মহুয়া আরও যুক্তি দিয়েছিলেন, লোকসভায় প্রশ্ন করে যে সব তথ্য মেলে, তা তথ্যের অধিকার আইনেও মেলে। তা ছাড়া তিনি শুধু প্রশ্ন ‘টাইপ’ করে জমা দেওয়ার জন্য হীরানন্দানিকে সংসদের পোর্টালের লগইন আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন। তাঁর সাংসদ হিসেবে সরকারি ই-মেলের আইডি, পাসওয়ার্ড দেননি। সেই ই-মেলে সরকারি নথি থাকে। সংসদের পোর্টালের লগইন আইডি দিয়ে ঢুকে শুধু মাত্র প্রশ্ন জমা করা যায়, এবং সাংসদ হিসেবে যাতায়াতের খরচ জমা করা যায়। সেখানে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন নেই। সংসদের পোর্টালের বাকি নথি অন্য যে কেউ দেখতে পারেন।
এথিক্স কমিটিকে আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, সংসদের পোর্টালে সাংসদেরা ঢুকে এমন অনেক নথি দেখতে পারেন, যা বাইরের কেউ দেখতে পারেন না। যেমন সংসদে কোনও বিল পেশ হওয়ার আগে তা পড়ে দেখার জন্য সাংসদদের দেওয়া হয়। যে সময় মহুয়ার লগইন আইডি অন্য কেউ ব্যবহার করেছিলেন, সে সময় ২০১৯-এর জম্মু-কাশ্মীর আসন পুনর্বিন্যাস বিলের খসড়া সাংসদদের দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে স্পর্শকাতর নথি দেশের শত্রুর কাছে চলে যেতে পারে। সাইবার হানার আশঙ্কাও থাকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আরও জানিয়েছে, হীরানন্দানি ভারতীয় নাগরিক হলেও তিনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে থাকার অনুমতি বা ‘রেসিডেন্সি রাইটস’ পেয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে বিদেশি নাগরিক রয়েছে। ফলে বিদেশি সংস্থার কাছে স্পর্শকাতর নথি ফাঁস হওয়ার বিপদ তৈরি হয়েছে। ২০১৯-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৩-এর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মহুয়া চার বার সংযুক্ত আরব আমিরশাহি গিয়েছিলেন। অভিযোগ, তার মধ্যে কয়েক বার দুবাইয়ের একটি নির্দিষ্ট ইন্টারনেট সংযোগ থেকে ওই সময়ে ৪৭ বার তাঁর লগইন আইডি ব্যবহার করা হয়েছিল। যা থেকে স্পষ্ট, দুবাই থেকে অন্য কেউ তাঁর লগইন আইডি কাজে লাগিয়ে সংসদের পোর্টালে ঢুকেছিলেন।
এ দিন এথিক্স কমিটির রিপোর্ট দেখে কংগ্রেস সাংসদ কার্তি চিদম্বরমের অভিযোগ, ‘‘কমিটি আগেই মহুয়া মৈত্রকে ‘ক্রিমিনাল’ বলে দিয়েছে। তার পরে তদন্তের সুপারিশ করছে!’’ ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক জি দেবরাজনের প্রশ্ন, ‘‘মহুয়া মৈত্রকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের কথা বলার কী যুক্তি রয়েছে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy