ড্রোন থেকে দুর্ঘটনাস্থল। ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে বাহানাগায় শনিবার। ছবি: রয়টার্স।
কার কণ্ঠস্বর?
চার দিকের অজস্র শব্দ, উদ্ধারকারীদের একে অন্যকে ছুড়ে দেওয়া নির্দেশ, ক্রেন দিয়ে কামরা সরানো বা গ্যাসকাটারে ইস্পাত কেটে ফেলার আওয়াজ। সে সবকে ছাপিয়ে ওটা কার মর্মান্তিক চিৎকার ছিটকে এল করমণ্ডল এক্সপ্রেসের এস-২ কামরা থেকে! খোঁজার উপায় নেই। ট্রেনটির এস-১ ও এস-২ কামরা দু’টিকে আলাদা করারই উপায় নেই তখন। উদ্ধারকারীরা গ্যাসকাটার হাতে নিয়েও থমকে আছেন। বুঝতে পারছেন না, কোথা থেকে কামরা কাটতে শুরু করবেন। বুঝতে পারছেন না, তা করতে গিয়ে ভিতরে আটকে থাকা কাউকে অজানতে আঘাত করে ফেলবেন কি না। বুঝতে পারছেন না, কী ভাবে এস-২ কামরায় ঢুকবেন, যাতে উদ্ধার করা যায় সেই মানুষটিকে, যাঁর আর্তনাদ শুনতে পেয়ে সেই মুহূর্তে থেমে গিয়েছেন সবাই।
শুক্রবার মধ্যরাতে ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে যখন উদ্ধারকাজ চলছে, তখনও জানা ছিল না, ঠিক কত জন মারা গিয়েছেন এই দুর্ঘটনায়। রেল সূত্রে বলা হচ্ছিল, করমণ্ডল এক্সপ্রেস, একটি মালগাড়ি এবং যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। শনিবার দিনভর উদ্ধারের সময়ে লাফিয়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। রাত পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা গিয়েছে, ২৮৮ জন মারা গিয়েছেন। তবে এই সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েই গিয়েছে। জখম এগারোশো পেরিয়েছে। নিখোঁজ বহু মানুষ।
রেলের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে গাফিলতির ইঙ্গিত। অন্তর্ঘাতেরও আশঙ্কা করছে কেন্দ্র। এনআইএ তদন্তও হতে পারে। দুর্ঘটনাটি ঘটে বাহানাগা বাজার স্টেশন ও তার আগের রেলগেটের মধ্যে। সেই জায়গায় চারটি লাইন রয়েছে। স্টেশনে একটি করে মেন আপ ও ডাউন লাইন এবং দু’পাশে দু’টি লুপ লাইন আছে। সূত্রের দাবি, প্রথম আপ লুপ লাইনে ছিল মালগাড়ি। তার পাশে আপ মেন লাইন ধরে যাওয়ার কথা ছিল চেন্নাইমুখী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের, দুর্ঘটনার সময়ে যার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২৮ কিলোমিটার। তৃতীয় লাইনটি ডাউন মেন লাইন। সেই লাইনে করমণ্ডলের উল্টো দিক থেকে আসছিল হাওড়ামুখী ডাউন যশবন্তপুর এক্সপ্রেস। সেটিও দ্রুত গতিতে ছুটছিল। চতুর্থ লাইনটি ডাউন লুপ লাইন। তাতেও ছিল একটি মালগাড়ি।
রেল সূত্রের দাবি, প্রাথমিক তদন্তে ইঙ্গিত মিলেছে যে, সম্ভবত পয়েন্ট (যেখান থেকে ট্রেন লাইন বদল করে) এবং সিগন্যালের সামঞ্জস্যের গোলমালেই করমণ্ডল প্রচণ্ড গতিতে আপ মেন লাইনে যাওয়ার বদলে আপ লুপ লাইনে ঢুকে পড়েছিল। ট্রেনটিকে মেন লাইনে যাওয়ার সিগন্যাল দেওয়া হলেও তার পয়েন্ট ঘোরানো ছিল লুপ লাইনের দিকে। লুপ লাইনে ঢোকার সময়েও ট্রেনের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫-৩০ কিলোমিটার থাকার কথা। তা-ও ছিল না। মেন লাইনে যাওয়ার তীব্র গতিবেগ নিয়েই করমণ্ডল লুপ লাইনে ঢুকে মালগাড়ির পিছনে আছড়ে পড়ে। করমণ্ডলের ইঞ্জিন উঠে যায় মালগাড়ির মাথার উপরে। লাইনচ্যুত হয় করমণ্ডলের ২৪টির মধ্যে ২১টি কামরা। ছড়িয়ে পড়া কামরার কয়েকটি গিয়ে ধাক্কা মারে পাশের ডাউন লাইনে উল্টো দিক থেকে আসাযশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসের পিছনের দিকে। তাতে ওই ট্রেনের পিছনের দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়। করমণ্ডলের একটি কামরা গিয়ে পড়ে চতুর্থ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির ইঞ্জিনের সামনে।
রেলের দাবি, সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করমণ্ডলের এস-১ ও এস-২ কামরা দু’টি। একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে দু’টি কামরা। সেখান থেকে উদ্ধারেই সব থেকে বেশি বেগ পেতে হয়েছে।দুর্ঘটনার পরে সব চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে রেলের ত্রুটি নিয়ে। ঘটনাস্থলে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এবং ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কাউকে রেয়াত করা হবে না। এই ঘটনার পিছনে যার গাফিলতি আছে, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। মুখ্যমন্ত্রী আঙুল তোলেনসমন্বয়ের অভাবের দিকে। রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, কমিশনার অব রেল সেফটিকে দিয়ে তদন্ত হবে। আরও একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের কথাও বলেন তিনি।
করমণ্ডলের সংরক্ষিত আসনে যাত্রী ছিলেন ১২৫৭ জন। যশবন্তপুরে ছিলেন ১০৩৯ জন। দু’টি ট্রেনেই অসংরক্ষিত কামরায় বহু যাত্রী ছিলেন। ট্রেনটিতে অনেক পরিযায়ী শ্রমিক ছিলেন। তাঁরা আসন না পেয়ে ট্রেনের মেঝেতে বসে যাচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কারা মৃত, কারা জীবিত, শনিবার রাত পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলেই একটি অংশের দাবি।
সারা দেশে বড় ধরনের রেল দুর্ঘটনাগুলির ৫৭ শতাংশেরই কারণ রেলকর্মীদের গাফিলতি— তথ্যের অধিকার আইনে জানিয়েছে রেল বোর্ডের সুরক্ষা বিভাগ। এ ক্ষেত্রেও তেমন ঘটল কি না, যে ইন্টারলকিং সিস্টেমের কথা বলে লাইন বন্ধ রেখে কাজ করে রেল, তাতে আদৌ কোনও লাভ হল কি না, এই সব প্রশ্ন নতুন করে উঠছে।
হাসপাতালে পড়ে রয়েছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে মোড়া সারি সারি মৃতদেহ। কোনও কোনও দেহের পোশাকের ভিতর থেকে এখনও বার বার বেজে উঠছে মোবাইলের রিংটোন। ঘটনাস্থল থেকে কিছু দূরে বাহানাগা হাই স্কুলে অস্থায়ী মর্গ। সেখানেও সার সার দেহ। রেলেরই চাদরে ঢাকা। আর সেই চাদর সরিয়ে মুখ দেখে নিজের ছেলেকে খুঁজছেন এক বৃদ্ধ। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘‘ছেলেটাকে খুঁজছি। কোথাও পাচ্ছি না।’’
পৃথিবীর সব থেকে কঠিন সন্ধানটি চলতে থাকল তার পরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy