গোধূলি আকাশে তখনও পড়ন্ত বেলার আঁকিবুকি। ফিকে হয়ে আসা আলোছায়ায় সবে দেখা দিয়েছে সন্ধের এক অস্পষ্ট তারা। অষ্টম শ্রেণি, সেই আবছা তারার দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘‘মোটাবেন ওই রকম এক তারার কাছে গিয়েছিল জানেন, ভগবানের খুব কাছাকাছি। খুব ইচ্ছে করে আমিও এক বার ভগবানের দর্শন নিয়ে আসি!’’
গ্রামের ‘অনুপমা বিদ্যালয়ের’ আট-ক্লাসের পড়ুয়া রাজন্য কুমারী রাভাল। লাল ফিতের জোড়া বিনুনি দুলিয়ে সে আপ্রাণ বোঝায়— ‘চাঁদ-তারার দেশে ভেসে পড়া মানেই তো দেবতার মুলুকে পাড়ি দেওয়া, তাই না!’ টিভির খবরে সে দেখেছে, ঈশ্বরের সেই বাগানে কেমন খোলা চুলে ভেসে বেড়াচ্ছে গ্রামের সুনীতা দিদি। ছোট্ট মেয়ের কল্পনায় ঈশ্বরের আকাশ আর মর্ত্যের মানুষের মাঝে রূপকথার এক সেতু এঁকে ফিরে এসেছে তার ‘মোটাবেন’ (বড়দি)সুনীতা দিদি। শুধু ছোটরা নয়, সেই বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের মাঝে এক ফালি পরাবাস্তবতা নিয়ে এখনও রয়ে গিয়েছে ঝুলাসান। নাসা’র নভশ্চর সুনীতা উইলিয়ামস পান্ড্যের পৈতৃক গ্রাম।
উটে টানা ভ্যান গাড়িতে হাইওয়ে, তারপর বাস ধরে দশ কিলোমিটার দূরের কলোল শহরে নামজাদা কলেজে প্রতি দিন পাড়ি দেয় দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী দীপিকা বারোত। তার কাছেও, ‘‘তে দেবী ছে, (তিনি সাক্ষাৎ দেবী), না হলে কেউ দেবতার দেশে পাড়ি দিতে পারে!’’ তাঁর পৃথিবী-প্রত্যাবর্তন রাতে তাই ভোর পর্যন্ত নাগাড়ে বাজতে থাকে গ্রামের সব ক’টি মন্দিরের ঘণ্টা। টানা সাত দিনের অগ্নিযজ্ঞে বিভোর হয়ে থাকে গোটা গ্রাম, রাতভর জ্বলতে থাকে আতশবাজি আর গ্রামবাসীরা ঘরে ঘরে কড়া নেড়ে বিলি করতে থাকেন পেঠা আর সোহন। চার পাশে এক বার চোখ বুলিয়ে কিঞ্চিৎ নিচু স্বরে টিপ্পনি কাটছেন গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, ‘‘ঝুলাসানের জাগ্রত দেবী, দোলা মাতা-র নব্য সংস্করণ হয়ে উঠেছে যেন সুনীতা!’’ তারপর যোগ করছেন, ‘‘সুনীতার পৈতৃক গ্রাম ঝুলাসান। তাঁর সাফল্যে উৎসব হতেই পারে, তাই বলে এক ‘অন্তরীক্ষযাত্রী’কে (নভশ্চর) নিয়ে ‘বৈচারিকসিদ্ধান্ত’ (অন্ধবিশ্বাস) ছড়ানো কি ঠিক?’’ অন্ধবিশ্বাস না হোক, যুক্তি-বিজ্ঞানের তুলনায় গুজরাতের এই প্রান্তিক গ্রাম যে ভক্তি-অর্চনায় বিভোর হয়ে আছে, গ্রামে পা রাখলেই তার আঁচ মেলে।
গ্রামের খান দশেক মঠ-মন্দিরের মাঝে একটি মাত্র উচ্চ প্রাথমিক স্কুল (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত)। পড়ুয়া সংখ্যা সাড়ে সাতশো। তবে ফি বছরই তা কমছে। গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়টি এ বার বারো ক্লাস পর্যন্ত হয়েছে বটে, ছাত্রছাত্রী শ’তিনেক। তবে, কলেজমুখী সাকুল্যে বারো জন। পঞ্চায়েতের মাতব্বর কিশোরভাই রাবাঢ়ের হিসেব বলছে, দশ ক্লাসের পঠন শেষ করেই ছেলেপুলেদের অধিকাংশ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের কলকারখানায় কাজের সন্ধানে।আর মেয়েদের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। কলেজে যাওয়ার সময় কোথায়!
তথ্য ও সম্প্রচার দফতরের প্রাক্তন কর্তা আহমেদাবাদের বিন্নুভাই পটেল বর্তমানে গুজরাতের নিম্নবর্গীয় সম্প্রদায়ের মানুষজনদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলছেন, ‘‘গুজরাতের অধিকাংশ গ্রামে শিক্ষার দৌড়ে পিছিয়ে পড়া এই অংশটার অবসর কাটে ধর্মের উঠোনে। ফলে যুক্তি নয়, অন্ধভক্তি আর ধর্মীয় বিশ্বাসে ভর করেই অধিকাংশ গ্রামীণ গুজরাতের হাঁটাচলা।’’ সুনীতা উইলিয়ামস আজ তাই প্রায় আরাধ্য এক দেবী।
আমদাবাদ শহর থেকে মেহসানা এক্সপেস ওয়ে বরাবর পাথর ঘষা মেঝের মতো মসৃণ রাস্তা। দু-ধারের রুখু জমিতে পরস্পরকে পাল্লা দিয়ে ঝলমল করছে পরিচিত ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার ক্যাম্পাস, বস্ত্র শিল্পের কারখানা, ভারী যন্ত্রাংশের শিল্পতালুক। শিল্পশহর কলোলকে পিছনে ফেলে রাস্তা বাঁক নিলেই উন্নয়নের ছটা বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ ছায়ায়। আঁকাবাঁকা সরু পথ, উঠে টানা ক্যারাভ্যান আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাবলাকাঁটার ঝোপ এড়িয়ে আহমেদাবাদ থেকে পাক্কা ৫১ কিলোমিটার দূরত্বে নিশ্চুপ জনপদ ঝুলাসান। গ্রামের মস্ত চাতাল থেকে ছড়িয়ে গেছে, আধভাঙা পাথুরে রাস্তা। শীর্ণ গলির দু’ধারে পুরনো বাড়ি যেন সোনার কেল্লার অস্পষ্ট প্রোফাইল। তারই মাঝে চুপ করে আছে পাণ্ড্যদের দোতলা পৈতৃক ভিটে। পঞ্চাশের দশকে গ্রামের সম্পর্ক চুকিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন সুনীতার বাবা দীপক। সুনীতার কাকাও প্রবাসী। পরিবারের যে দু-এক জন রয়ে গিয়েছেন তাঁরাও ছড়িয়ে গিয়েছেন অদূরের আমদাবাদ বা মুম্বই শহরে। ভগ্নপ্রায় সুনীতাদের বাড়ির সামনে তাই ধুলোর হুটোপুটি। ভাঙা জানালার খোপে পায়রার পরিপাটি সংসার।
কিশোরভাই জানান, গ্রামীণ উন্নয়নে সরকারি আনুকুল্যের চেয়ে ঢ়ের বেশি দক্ষিণা আসে প্রবাসী পাটিদার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। তবে সে অনুদানের অঙ্ক স্কুলের উন্নয়নের চেয়ে ঢ়ের বেশি ঢ়লে পড়ে মন্দির সজ্জা ও সংস্কারে। দোলামাতা মন্দিরের চাতাল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তার টাটকা নির্দশন। কালো পাথরে সোনালি হরফে অগুন্তি প্রবাসী প্রেরকের নাম আর ডলারে পাঠানো প্রভূত অনুদানের অঙ্ক সসম্ভ্রমে ঘুরিয়ে দেখান মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দীনেশ পাণ্ড্য। তারপর বলেন, ‘‘দেখছেন, মানুষ দু’হাত ভরে দিয়েছে!’’
স্পেস স্টেশনের ন’মাসের আস্তানা ছেড়ে তারার মতো মাটিতে নেমেছেন সুনীতা উইলিয়ামস। তাঁর পৈতৃক ভিটে ঝুলাসানও তাঁকে আঁচল ভরে দিয়েছে বটে— ‘তে দেবী ছে’, তিনি সাক্ষাৎ দেবী!
(চলবে)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)