চন্দ্রশেখর রাও। ছবি: পিটিআই।
ভোটবাজারে শীতকালে এসে শেষ পর্যন্ত বর্ষাতির খোঁজ করতে হবে, কে জানত!
নিছক বহিরাগতের তা জানার কথাও নয়। কিন্তু ডিসেম্বরের দোরগোড়ায় আকাশের এমন গোমড়া মুখে তাজ্জব প্রবীণ তেলঙ্গানাবাসীও। সকালে যেটা ইলশেগুঁড়ি, বেলা পার হতেই অনেক রাস্তায় কাগজের নৌকো ভাসানোর দশা।
বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ এই অকাল বর্ষা এনেছে হায়দরাবাদে। পূর্বাভাস, থাকবে আরও দিন তিনেক। এখানকার আড্ডাপ্রিয় কফি ও কাবাব ঠেকগুলি বলছে, এটি নাকি আসলে 'ভোটের বর্ষা'! যেমন চমক আবহাওয়ায়, তেমনই চমক দেখবে তেলঙ্গানাবাসী এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে। উল্টেপাল্টে যেতে পারে নাকি পুরনো হিসেব।
ভিজতে ভিজতেই সভা করছেন নেতারা। অনেক সূচি বাতিলও হচ্ছে। বিআরএস-এর কার্যনির্বাহী সভাপতি তথা চন্দ্রশেখর রাওয়ের পুত্র কেটি রাম রাওয়ের এক ঝলক দর্শন পাওয়া গেল জুবিলি রোডের কাছে প্রশাসন নগরে। নির্ধারিত পদযাত্রার বহর কমিয়ে গাড়িতে উঠছেন। তার আগে স্থানীয় সাংবাদিকদের তেলুগুতে যা বললেন, পরে হিন্দি অনুবাদে বোঝা গেল, আমির খানের ২০০৮ সালের একটি সিনেমার উল্লেখ করছেন তিনি, ভোট তরজায়।
কেটিআর-এর কথায়, ‘‘বিরোধী নেতাদের গজনীর দশা হয়েছে! তাঁরা দেখি সবই ভুলছেন! এত উড়ালপুল, চওড়া রাস্তা, বিভিন্ন বিদেশি বহুজাতিকের লগ্নি, চোখ ধাঁধানো বিল্ডিং যে তৈরি হয়েছে গত ন'বছরে, কিছুই তাঁরা মনে রাখতে পারছেন না!’’ তাঁর ভোটের আশ্বাস, মেট্রো রেলের ২৫০ কিলোমিটার সম্প্রসারণ, নিকাশি ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রে ২০ হাজার কোটি টাকা ঢালা।
শোনা গেল, তার কিছু ক্ষণ আগেই পিতা কেসিআর হুঙ্কার দিয়ে তেলঙ্গানা প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান এবং কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী 'মুখ' রেবন্ত রেড্ডিকে সরাসরি নিশানা করে বলেছেন, "কংগ্রেস বিশটা আসনও জিততে পারবে না। রেবন্ত রেড্ডি যদি ভেবে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তাঁকে এখনও বলে রাখছি, আশা ছেড়ে দিন। কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাঁর মতো নেতা রাজ্যের জন্য অভিশাপ। প্লেগ মহামারির মতো। রাজনীতিতে এঁদের কোনও জায়গা নেই।"
টাকা যে ‘জলের মতো বইয়ে’ দিচ্ছে বিআরএস, এমন কথা শোনার জন্য বিশেষ কান পাততে হচ্ছে না এখানে। বিমানবন্দরের ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে হোটেলের রিসেপশনিস্ট, একটু আলাপের পরই এই কথা অব্যর্থ ভাবে তুলছেনই। যে কোনও ভোট-আড্ডার কেন্দ্রীয় বিষয়ই এটি। সত্যি বলতে কী, রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী খুব একটা বেখাপ্পাও নয়। যেটা বেখাপ্পা, সেটা হল, তেলঙ্গানা আবেগের চূড়ামণি কে চন্দ্রশেখর রাওকে এ ভাবে নাম করে রেবন্তকে 'মুখ্যমন্ত্রী' বলে নিজেই উল্লেখ করে আক্রমণ শানাতে হচ্ছে কেন? তাঁর তো হাসতে হাসতে জেতা উচিত গত বারের মতো।
শোনা যাচ্ছে, ভোটকালীন আকাশের মতো, তাঁরও মুখ এ বারে প্রসন্ন নয়। দীর্ঘ দিন প্রসারভারতীর প্রিন্সিপাল ডিজি হিসাবে কাজ করার পর নিজের রাজ্যে ফিরে ভোট গবেষণা, এনজিও, সমীক্ষায় মন দিয়েছেন প্রবীণ এনভি রেড্ডি। পক্ককেশ বলছেন, "এ বারের ভোটে এটাই চমক যে কে সি আর-এর বিরুদ্ধে প্রথম বার জনক্ষোভ তৈরি হয়েছে, ন'বছরের শাসনকালের পর। যেটা ২০১৮ সালের ভোটে আদৌ ছিল না। ফলে বিধানসভার ভোটে জয় এ বার তাঁর কাছে নিছক উদ্যানভ্রমণ হবে না, আপনারা বাইরে থেকে এসে যেটা ভাবছেন।" তাঁর যুক্তি, বিক্ষোভের, বঞ্চনার অনেক কারণ তো রয়েছেই। কিন্তু তার সঙ্গে জুড়েছে মানুষের এই সন্দেহ যে বিজেপি এখানে 'আত্মঘাতী গোল' করছে শুধুমাত্র কেসিআর-কে জেতানোর জন্য। অন্য ভাবে বলতে গেলে কংগ্রেসকে হারানোর জন্য। বিজেপি-র সঙ্গে এই পরোক্ষ সমঝোতা ভাল ভাবে নেননি মানুষ। ভাবছে, তাঁদের ঠকানো হয়েছে।
কী সেই আত্মঘাতী গোল?
২০২০ সালে যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রেম পুরভোটে আশাতীত ফল করল বিজেপি, সেই বান্দি সঞ্জয়কে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া প্রথম আত্মঘাতী গোল বলে মনে করছেন এখানকার রাজনৈতিক মহল। একটাই তফাৎ, আত্মঘাতী গোল ফুটবলে ভুলক্রমে হয়, এ ক্ষেত্রে কৌশল করেই হয়েছে। বান্দি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও এখানে প্রশ্নাতীত। বান্দিকে রাখা হলে বিজেপি অন্তত কুড়িটি আসন অনায়াসে পেত তেলঙ্গানায়। কিন্তু তাঁকে বদলে আনা হল কিষান রেড্ডিকে। যাঁর এখন আর বিশেষ কিছু করার নেই।
রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, ত্রিমুখী (আসাদুদ্দিন ওয়েইসি নিজের গড় পুরনো হায়দরাবাদ থেকে ৭টি আসনের বেশি পাবেন না, এটা স্বতঃসিদ্ধ) অর্থাৎ বিআরএস- কংগ্রেস- বিজেপি-র মধ্যে মারকাটারি লড়াই হলে বিআরএস শক্তিহীন হত। লাভ হত কংগ্রেসের। সেটা কোনও মূল্যেই হতে দিতে চাননি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ। আবগারি দুর্নীতিতে অন্যত্র ক্ষমাহীন কেন্দ্রীয় সংস্থা। আপ-এর হাই প্রোফাইল মন্ত্রীও জেলে। কিন্তু কেসিআর-এর মেয়ে কবিতা, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছেন, যাঁর বিরুদ্ধে ‘প্রমাণের অভাব নেই’ কেন্দ্রের কাছে এবং যিনি আগে কেন্দ্রীয় সংস্থার তলবও পেয়েছেন।
এই আঁতাঁতের অভিযোগ কংগ্রেসও প্রচারে আনছে। এখানকার সক্রিয় কংগ্রেস নেতা তথা বিধায়ক মাল্লু ভাত্তি বিক্রমার্ক দলীয় অফিসে বসে বললেন, ‘‘এই তো এক সপ্তাহ আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এসে বলে গেলেন, কৃষকদের পাম্পসেটে কেসিআর এখনও কোনও মিটার বসাতে পারলেন না। তিনি কৃষক বিরোধী। এ কথা যে তিনি আসলে কেসিআর—এর সুবিধা করার জন্যই বললেন, তা না বোঝার কথা নয় মানুষের। কারণ, শুধু কেসিআর-ই নন, প্রাক্তন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডির সময় থেকেই বিনামূল্যে রাজ্য সরকার কৃষকদের বিদ্যুৎ দিয়ে আসছে।’’
নির্মলার এই ফুলটস বলে ছক্কা হাঁকিয়ে কেসিআর তৎক্ষণাৎ বলেছেন, ‘‘আপনারা দেখলেন, সরকার আমার উপর চাপ তৈরি করছে পাম্পে মিটার বসিয়ে আপনাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্য। আমি কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছিলাম, কিন্তু মোদী সরকার তা দেয়নি। বরং পূর্বশর্ত রেখেছে, যদি আমি আপনাদের পাম্পে মিটার বসাই, তবেই এই ঋণ পাওয়া যাবে। কিন্তু তেলঙ্গানার চাষিদের উপর চাপ বাড়তে দেব না।’’ নিজাম শহরের আকাশ থেকে অকাল মেঘ তাড়িয়ে আগামী ৩ ডিসেম্বর রোদ্দুরের মুখ দেখার জন্য, ছল বল কৌশল অর্থ — সব অস্ত্র নিয়েই মাঠে নেমেছেন কালভাকুন্তিয়া চন্দ্রশেখর রাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy