যুগেন্দ্র পওয়ারের হয়ে প্রচারে সুপ্রিয়া সুলে। —নিজস্ব চিত্র।
নিয়মিত চার্টার্ড বিমান ওঠানামা করছে। বিমানবন্দরের মাপে ও ধাঁচে তৈরি পেল্লায় বাস টার্মিনাস। শিল্পাঞ্চলে একের পর এক কারখানা। বিরাট বস্ত্র পার্ক। একাধিক চিনির কল। স্কুল, কলেজ, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসির কলেজ। সমবায় ব্যাঙ্কের সদর দফতর এখানে আয়তনে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের দফতরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। বড় বড় শপিং মল। রেস্তরাঁ, কফি শপ। ঝাঁ চকচকে সড়ক। মাঝে খেজুর গাছের সারি।
রাজ্যের রাজধানী শহর নয়। মেট্রোপলিটন শহর নয়। পুণে জেলার নিতান্ত মহকুমা শহর। নাম বারামতী। দেখলে মনে হবে, মহাভারতে ময়দানবের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী।
মহাভারত থাকবে, আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হবে না, তা কি হয়! বারামতী এখন মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনের কুরুক্ষেত্র। একই পরিবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে। কাকা বনাম ভাইপো। ভাইপো বনাম কাকা। দাদা বনাম বোন। কাকিমা বনাম ভাসুরপো। নানা রকম পারিবারিক লড়াই।
বারামতী বাস টার্মিনাস দেখে চমকে যাওয়ার পরে যদি কাউকে প্রশ্ন করেন, এই উন্নয়নের পিছনে কার অবদান? সবাই উত্তর দেবেন, শুরু হয়েছিল শরদ পওয়ারের হাত ধরে। মহারাষ্ট্রের রাজনীতির পিতামহ ভীষ্ম। গত ছয় দশকে মরাঠা রাজনীতির প্রতিটি মোড়ে তাঁর নিশ্চিত উপস্থিতি। বারামতীর ‘সাহেব’। পরে বারামতীকে সাজিয়ে তুলেছেন সাহেবের ভাইপো, অজিত পওয়ার। মহারাষ্ট্র রাজনীতির ‘অজিত দাদা’। বারামতীর ‘কামচা মানুষ’ বা কাজের মানুষ। যিনি শুধু বাস টার্মিনাস তৈরির কাজ দেখভাল করতেই একশো বার এসেছেন। উপর থেকে নজর রেখেছেন শরদ পওয়ার।
তা হলে ভোটে জিতবে কে? এখানেই দ্বিধাবিভক্ত বারামতী।
চিনির কল থেকে আখের চাষ, ব্যাঙ্ক থেকে ডেয়ারি— বারামতীর রাজনীতি সমবায় সংস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বারামতী সমবায় ব্যাঙ্কের ব্যবসার পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা। চেয়ারম্যান থেকে পরিচালন পর্ষদের কর্তারা সকলেই অজিত পওয়ারের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবীন্দ্র ওয়াঙ্কর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফল নিয়ে নিশ্চিত নন। তাঁর কথায়, “এটা আবেগ বনাম আনুগত্যের লড়াই। বারামতীর আবেগ, আনুগত্য পওয়ার পরিবারকে ঘিরে। অথচ পরিবারই দ্বিখণ্ডিত।”
গত বছর শরদ পওয়ারের এনসিপি ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে তাঁর ভাইপো অজিত পওয়ার বিজেপির সঙ্গে জোট করেছিলেন। লোকসভা নির্বাচনে শরদ-কন্যা সুপ্রিয়া সুলে বনাম অজিতের স্ত্রী সুনেত্রার লড়াই দেখেছিল বারামতী। বউদি বনাম ননদের লড়াইতে প্রায় দেড় লক্ষ ভোটে ননদিনী জিতেছিলেন। এ বার বারামতী বিধানসভা কেন্দ্রে অজিত নিজেই প্রার্থী। আট বারের বিধায়ক, রাজ্যের বিজেপি জোট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পাঁচ বছর আগে বারামতীতে ১ লক্ষ ৬২ হাজার ভোটে জিতে রেকর্ড করেছিলেন। তখনও অবশ্য এনসিপি দ্বিখণ্ডিত হয়নি। পওয়ার পরিবারের মাঝে পাঁচিল ওঠেনি। লোকসভা ভোটে বারামতী বিধানসভা এলাকায় অজিতের স্ত্রী ৪৮ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিলেন। নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন না অজিত।
অজিত তাঁর কাকা শরদ পওয়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দল ভেঙেছেন। শরদ পওয়ার ভাইপো অজিতের বিরুদ্ধে অজিতেরই ভাইপো যুগেন্দ্র পওয়ারকে প্রার্থী করেছেন। যুগেন্দ্র অজিতের ভাই শ্রীনিবাসের ছেলে। অজিতের হয়ে তাঁর স্ত্রী সুনেত্রা, দুই বোন, বিজয়া ও রজনী প্রচার করছেন। যুগেন্দ্রর হয়ে শরদ, সুপ্রিয়া তো বটেই, বরাবর অন্তরালে থাকা শরদের স্ত্রী প্রতিভা পওয়ারও বাড়ি বাড়ি প্রচারে নেমেছেন। কাকিমাকে তাঁরবিরুদ্ধে ময়দানে দেখে বিস্মিত অজিত বলেছেন, “কোনও দিন কাকিমাকে নির্বাচনী প্রচারে দেখিনি। এখন কেন? ভোটের পরে কাকিমার কাছেজানতে চাইব।”
পরিবারের মধ্যে এই লড়াই মানতে পারছেন না সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে। বউদির বিরুদ্ধে ভোটে লড়ার পরে এ বার সামনে জ্যাঠতুতো দাদার বিরুদ্ধে প্রচারে। বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ। মহাভারতের অর্জুনের অবস্থা। তাঁকে পথ দেখান কোন কৃষ্ণ? সুপ্রিয়া বলছেন, “আমাকে ঠাকুমা শারদাবাই পওয়ার চোখের জল না ফেলে লড়াই করতে শিখিয়েছিলেন। বিজেপি আমাদের দলে, পরিবারে ভাঙন ধরিয়েমহাপাপ করেছে।”
এই আবেগকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়ে চুরাশিতে পা দিতে চলা শরদ পওয়ার ঘোষণা করেছেন, এটাই তাঁর শেষ নির্বাচন। অশক্ত শরীর। মুখের ক্যান্সারের ফলে কথা জড়িয়ে যায়। তবু একের পর এক জনসভা করছেন পওয়ার। প্রভাবশালীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। অজিত বিজেপির সঙ্গে থাকলেও শরদ পওয়ারের সঙ্গে তাঁর পুরনো সম্পর্ককে সম্মান জানিয়ে নরেন্দ্র মোদীও বারামতীতে প্রচারে যাননি। পওয়ার কিন্তু ‘বিজেপির উস্কানিতে’ ভাইপোর ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র কথা স্মরণ করিয়েই দিচ্ছেন। মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে ২৮৮টি আসনের মধ্যে ৩৫টিতে শরদ পওয়ারের এনসিপি-র সঙ্গে অজিত পওয়ারের এনসিপি-র মুখোমুখি লড়াই।
অজিতের শিবির মনে করছে, বিজেপির বিরুদ্ধে দল ভাঙাভাঙি নিয়ে ক্ষোভ লোকসভা নির্বাচনে বয়ে গিয়েছে। সে বার মানুষ ‘সুপ্রিয়া তাই’কে ভোট দিয়ে ‘পওয়ার সাহেব’কে সমর্থন করেছিল। অজিতের নির্বাচনী ম্যানেজার কিরণ দাদা-গুজরের মতে, “অজিত দাদা চল্লিশ বছর ধরে বারামতীকে সাজিয়ে তুলেছেন। ওঁর জন্যই উন্নয়নে বারামতী গোটা দেশের সামনে মডেল। বারামতী জানে, অজিত দাদা বিধায়ক না থাকলে উন্নয়ন থমকে যাবে।” দুই শিবিরই মানছে, লড়াই কাঁটায় কাঁটায়। যে-ই জিতুন, সামান্য ব্যবধানে জিতবেন।
‘অজিত দাদা’র বিরুদ্ধে প্রার্থী, তাঁর ভাইপো যুগেন্দ্র পওয়ার রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। শরদ পওয়ারের তৈরি শিক্ষা সংস্থা বিদ্যা প্রতিষ্ঠানের কোষাধ্যক্ষ। বারামতী কুস্তিগির পরিষদের প্রধান। মুম্বই-পুণে-বস্টনে পড়াশোনা করে এসে বাবার সরযূ শিল্প সংস্থায় কাজ করছিলেন। সামাজিক কাজকর্মে জড়িত থাকলেও নির্বাচনের ময়দানে প্রথম। তা হলে লড়বেন কী ভাবে? ‘দিওয়ার’-এ ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের বাকযুদ্ধে শশী কপূর বলেছিলেন, ‘মেরে পাস মা হ্যায়’। বয়সে বত্রিশের কোঠার যুগেন্দ্র বলছেন, “আমার কাছে শরদ পওয়ার সাহেব রয়েছেন। যিথে সাহেব, তিথে বারামতীকর।” যেখানে সাহেব, সেখানেই বারামতীবাসী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy