ভোপাল গ্যাস কাণ্ডে মৃতদের স্মরণ। —নিজস্ব চিত্র।
“ভোপাল-কাণ্ডে মামুলি গ্যাস-পীড়িত কে? যাঁরা গ্যাস পীড়িত, তাঁদের কেউ সে দিনই মৃত, অথবা বেঁচে থেকে মৃত।”– বলে উঠলেন জ়হুর আহমেদ। গ্যাসপীড়িত আহমেদ দম্পতি ওই ঘটনার পরে চার সন্তানের জন্ম দিয়েও হারিয়েছেন তাদের। ভোপালের রুসল্লি মসজিদের ঠিক উল্টো দিকের এলাকার এই বাসিন্দার চোখের জল শুকিয়ে দিয়েছে সেই দগদগে ঘা।
ভোপালি মেজাজের বৃদ্ধ জ়হুর এক বছর আগে হারিয়েছেন স্ত্রীকে। ১৯৮৪-র ঘটনার রাতে তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে দম্পতি থাকতেন কাজী ক্যাম্প এলাকায়। জ়হুরের স্ত্রী তখন ছ’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। জন্ম দেওয়ার আট মাসের মাথায় মৃত্যু হয় সেই সন্তানের। এর পরে আরও তিন বার অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি। ছ’মাস, ২৫ দিন এবং দু’ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয় সদ্যোজাতদের।
সে রাতে সাড়ে ১২টা নাগাদ মহল্লায় হইচই শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন জ়হুর। যেন বাতাসে লঙ্কা ছড়িয়ে দিয়েছিল কেউ। চোখে তীব্র জ্বলন আর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এর পর থেকে বাকি চার ছেলেমেয়ে ও দম্পতির নিত্যসঙ্গী ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও চোখের সমস্যা।
জেপি নগরের কলাবাই বিশ্বকর্মার চোখের জলও যেমন চল্লিশ বছর পরেও শুকোয়নি। ওই রাত কেড়েছে তাঁর সতুকে। সত্যনারায়ণ। বছর তিনের শিশুটি সবে বায়না করা শিখছিল। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে তেমনই তার শেষ বায়না ছিল, ‘মাম্মি দুধ পিনা হ্যায়।’ ছেলেকে কোলে করে ছুটতে থাকা কলাবাই এর পরেই বুঝলেন, চিরতরে থেমে গিয়েছে সতুর ধুকপুকুনি।
মনে আছে, মৃত আর অর্ধ-মৃত মানুষ তুলতে তুলতে নিয়ে যাওয়া একটি লরি এসে থামে কলাবাইয়ের সামনে। তাতেই ছেলে কোলে ঠাঁই হয় তাঁর। জ্ঞান যখন এল, তখন কলাবাই হামিদিয়া হাসপাতালের শয্যায়। কাঁধ থেকে নামিয়ে শেষ বার ছেলের মুখটাও দেখা হয়নি। একটু থেমে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে প্রৌঢ়া বলেন, “আমার বাঁচার কথা ছিল না। সে রাতে ও ভাবে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করায় আজ আপনার সামনে বসে আছি।” তখন বছর কুড়ির তরুণী তিনি। পাঁচ আর তিন বছরের জগদীশ ও সত্যনারায়ণকে নিয়ে ঘরেই শুয়েছিলেন। রাত দুটো। তীব্র কাশি আর চোখ জ্বালা শুরু হল আচমকা। সেই সময়ে রাস্তার উল্টো দিকের কারখানা থেকে সাইরেন বাজল। বিপদ বুঝে বড় ছেলেকে নিয়ে বিশ্রামঘাটের দিকে ছোটেন কলাবাইয়ের স্বামী বদ্রিপ্রসাদ বিশ্বকর্মা। শীতের ঘন কুয়াশার মতো গ্যাসের চাদরে কিছু না দেখতে পেয়ে কলাবাই স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উল্টো পথে পৌঁছে যান ছোলায়। ছেলে জল খেতে চাইলে সামান্যই দেন। তাতেই পেট ফুলে ওঠে শিশুর। শুরু হয় শ্বাসের প্রবল ওঠানামা।
১৯৮৪-র পরে আরও ছয় মেয়ের জন্ম দিয়েছেন কলাবাই। সবার ছোট মেয়ের বয়স ছাব্বিশ। সেই তরুণীও শ্বাসকষ্টে জেরবার। বড় ছেলে জগদীশ সারা বছর অ্যাজ়মায় ভোগেন। কিডনিতে পাথর, চর্মরোগ, শরীরে প্রবল যন্ত্রণা তাঁর সঙ্গী। জগদীশের বড় মেয়ে বছর তেইশের নন্দিনীর কিডনিতে জমেছে পাথর। মেরুদণ্ডের যন্ত্রণা, চর্মরোগ আর শ্বাসকষ্ট ভোগাচ্ছে তাঁকেও।
সেই রাতে কাউকে হারাননি জেপি নগরের পুরনো বাসিন্দা নাথুরাম সোনি। তবে বছর একাশির বৃদ্ধের এক মেয়ে দুর্ঘটনার বছর আটেক পরে আত্মঘাতী হন। চার মেয়ে, এক ছেলের বাবা নাথুরাম বলছিলেন “পড়াশোনায় সব থেকে ভাল ছিল ওই মেয়ে। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে অসুস্থ থাকত। চিকিৎসা করাতে পারিনি। শরীরের সেই কষ্টে আত্মঘাতী হয় মেয়েটা।”
গ্যাস-কাণ্ডের পরে জন্মায় নাথুরামের ছেলে। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি শৈশব থেকেই। দু'বার অস্ত্রোপচার হয়েও অবস্থা বিশেষ বদলায়নি। নাথুরামের স্ত্রী, অন্য মেয়েরা এবং নাথুরাম ডায়াবিটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের শিকার। এক সময়ে ভোপাল স্টেশনে তেলেভাজা বানিয়ে বিক্রি করতেন, সেই কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন বহু বছর।
হাত-পা থাকা মানুষগুলি গ্যাসের প্রভাবে রোগ জর্জরিত হয়ে কর্মহীন হওয়ার প্রতিদানে সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। “কী হয় এতে? ঘটনার কয়েক বছর পর্যন্ত মাসে দুশো টাকা করে পেনশন মিলত। চিকিৎসার খরচ তো তার অনেক বেশি! গ্যাসপীড়িতের কার্ড থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ দিতে হয়। কেন এত অমানবিকতা সহ্য করছি আমরা? আমাদের দোষটা কী ছিল?” প্রশ্ন নাথুরামদের।
“চল্লিশ বছর অনেকটা সময়। এ বার আমরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ চাই। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ইউনিয়ন কার্বাইডের ফেলে রাখা রাসায়নিক বর্জ্যে ভূগর্ভস্থ জল আর বাতাসের দূষণ ঢুকে চলেছে শরীরে, তার অবসান চাই।”— এই সব দাবিতে ২ ডিসেম্বর থেকে ভোপাল জুড়ে ছোট ছোট পদযাত্রা, প্রদর্শনী ও জনসভা হচ্ছে। দুর্ঘটনার ৪০ বছর পূর্তিতে, মঙ্গলবার জেপি নগরে গ্যাস-কাণ্ডের প্রতিবাদে তৈরি মূর্তির পাদদেশে এক অনু্ষ্ঠানের আয়োজন করে ভোপাল গ্যাস পীড়িত সংগঠন। —যথাযথ ক্ষতিপূরণ মিলবে কবে?’ —এই প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে নাম সই করে পোস্টকার্ড পাঠাচ্ছেন তাঁরা।
‘‘চল্লিশ বছরে আদালতের জল অনেক বার গড়াল। কত সরকার বদলাল। কেউ তো মালিকদের শাস্তি দিল না! কেউ তো আমাদের মানুষ ভাবল না। ভাবলে কি ছুড়ে ভিক্ষে দিত!’’— সবার হয়ে প্রশ্ন তুললেন বৃদ্ধ সেবক প্রসাদ।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy