প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নেতাজির ছবি উপহার দিলেন বসু পরিবারের সদস্যরা। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
আগামী বছর ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন থেকেই কেন্দ্রের হেফাজতে থাকা নেতাজি সংক্রান্ত গোপন নথি প্রকাশ করার প্রক্রিয়া শুরু করবে কেন্দ্র। আজ বসু পরিবারের প্রায় ৩৫ জন সদস্যের সঙ্গে দেখা করে এই আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর তার পরেই প্রশ্ন উঠেছে, নথি প্রকাশের নীতিগত সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া হয়েই থাকে, তা হলে সেই কাজ শুরু করতে তিন মাস ব্যয় করা হবে কেন? রাজনীতিকদের অনেকের ধারণা, বছর গড়ালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। আর নেতাজিকে ঘিরে বাঙালির আবেগের কথা সকলের জানা। ভোটের মুখে সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির পালে বাতাস টানতেই অঙ্ক কষে নথি প্রকাশের দিন বেছেছেন প্রধানমন্ত্রী। কারও কারও আবার পাল্টা বক্তব্য, এই ধরনের গোপন নথি হুট বললেই প্রকাশ করে দেওয়া সম্ভব নয়। সব কিছু খতিয়ে দেখতে কিছু সময় লাগবেই।
নেতাজি নথি নিয়ে কেন্দ্রকে অবশ্য চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। গত মাসে রাজ্য সরকারের হাতে থাকা ৬৪টি গোপন ফাইল প্রকাশ করে দেন তিনি। এবং বলেন, কেন্দ্রেরও উচিত তাদের হাতে থাকা সব ফাইল প্রকাশ করে দেওয়া। একই দাবিতে সরব হয়েছিলেন বসু পরিবারের সদস্যরাও। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে থাকা দু’টি গোপন ফাইল প্রকাশ করার পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন বসু পরিবারের কয়েক জন সদস্য। তখনই সেই দাবি জানান তাঁরা। রাজ্য সব ফাইল প্রকাশের পরে ফের মোদীর সঙ্গে দেখা করার আর্জি জানান তাঁরা। আজ বসু পরিবারের অনেক বড় প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে বৈঠকের পরে টুইটারে মোদী লিখেছেন, ‘ইতিহাসের কণ্ঠরোধ করার কোনও প্রয়োজন নেই। যে দেশ ইতিহাসকে ভুলে যায়, তার ইতিহাস গড়ার ক্ষমতা নেই।’ সাত রেসকোর্সে বসু পরিবারের সঙ্গে বৈঠকের ছবিও পোস্ট করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সূত্রের খবর, অন্য যে ছ’টি দেশে নেতাজি সংক্রান্ত গোপন নথি রয়েছে, সেগুলিও প্রকাশ্যে আনার জন্য তিনি ব্যক্তিগত ভাবে তৎপর হবেন বলে আজ বসু পরিবারের সদস্যদের আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার পর নেতাজি রাশিয়ায় ছিলেন বলেও বিভিন্ন সময়ে দাবি উঠেছে। আগামী ডিসেম্বরেই রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন মোদী। টুইটারে তিনি লিখেছেন, রুশ সরকারকেও তিনি এই ব্যাপারে অনুরোধ করবেন।
হিসেব বলছে, বর্তমানে নেতাজি সংক্রান্ত অন্তত ১৪৩টি ফাইল রয়েছে কেন্দ্রের কাছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে রয়েছে ৩৯টি (ছিল মোট ৪১টি, যার মধ্যে দু’টি গত বছর প্রকাশ করে দেওয়া হয়), বিদেশ মন্ত্রকে রয়েছে ২৭টি, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর হেফাজতে রয়েছে ৭৭টি। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে আছে প্রায় ৬০ হাজার পাতার নথি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এখনও যে ফাইলগুলি রয়েছে, তার মধ্যে ‘টপ সিক্রেট’ ৪টি, ‘সিক্রেট’ ২০টি, ‘ক্লাসিফায়েড’ ৫টি, ‘আনক্লাসিফায়েড’ ১০টি। এর মধ্যে কোন ফাইলগুলি প্রথম ধাপে প্রকাশ্যে আনা হবে তা স্পষ্ট না হলেও যে ভাবে মোদী বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়েছেন, তা ইতিবাচক বলেই মনে করছেন বসু পরিবারের সদস্যেরা। যদিও অনেকের মতে, গোটা বিষয়টির নেপথ্যেই রয়েছে রাজনীতির দড়ি-টানাটানি। যার এক দিকে যদি মোদী থাকেন, অন্য দিকে মমতা।
গত বছর প্রকাশিত হওয়া ফাইল দু’টির তথ্যে দেখা গিয়েছিল, নেতাজির অন্তর্ধানের পরেও তাঁর পরিবারের উপর চলেছে গোয়েন্দাদের নজরদারি। স্বাধীন ভারতে দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ— দুই জায়গাতেই তখন কংগ্রেসের সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই এই ফাইল প্রকাশ্যে আসায় অস্বস্তিতে পড়ে কংগ্রেস। তারা অভিযোগ করে, রাজনৈতিক স্বার্থে নেতাজিকে ব্যবহার করছেন মোদী। তাই ‘বেছে বেছে’ ফাইল প্রকাশ করা হচ্ছে। সেই সময়ে কেন্দ্রের হাতে থাকা গোপন ফাইলগুলি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গড়ার কথাও ঘোষণা করেছিল মোদী সরকার।
বিজেপি-সূত্রের বক্তব্য, নেতাজি-ফাইল ঘিরে মূলত দু’ভাবে রাজনৈতিক ফসল তোলার পরিকল্পনা করেছিল দল। এক, নেতাজির অন্তর্ধান-প্রশ্নে জওহরলাল নেহরুর সরকারের মনোভাব কী ছিল, তা টেনে এনে কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলা। দুই, পশ্চিমবঙ্গে দলের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে নেতাজি-প্রশ্নে বাঙালি ভাবাবেগকে কাজে লাগানো। অর্থাৎ বকলমে, বিধানসভা ভোটের মুখে মমতা সরকারকেও চাপে ফেলা।
বস্তুত, গত মাসে মমতা যে ভাবে রাজ্যের হাতে থাকা ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করেছিলেন, তাতে ভোটেরই অঙ্ক দেখেছিলেন কেউ কেউ। মমতা সেই সময়ে বলেছিলেন, ‘‘কাগজগুলি প্রকাশ্যে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনেক বার অনুরোধ করেছি। কিন্তু কিছু হয়নি।’’ রাজ্যের এই নথিগুলিতে অন্তর্ধান সংক্রান্ত বিশেষ কোনও তথ্য না থাকলেও মমতার এই পদক্ষেপে কিছুটা চাপে পড়ে যান মোদী। রাজ্যের ফাইল প্রকাশের দু’দিনের মাথায় রেডিওয় ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জানান, অক্টোবরে নেতাজির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি। আজ সেই বৈঠকে বসু পরিবারের সদস্যেরা ছাড়াও ছিলেন ১৫ জন গবেষক। বসু পরিবারের পক্ষ থেকে নেতাজির তিনটি ছবি, তাঁর সামরিক পোশাকের ধাঁচে একটি জ্যাকেট প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দফতরের হেফাজতে থাকা ফাইল দু’টি গত বছর প্রকাশ করা হলেও সম্প্রতি তথ্য জানার অধিকার আইনে এই সংক্রান্ত আবেদনে আর সাড়া দেয়নি মোদী সরকার। সেই সময়ে বলা হয়েছিল, নেতাজি সংক্রান্ত ফাইলগুলি স্পর্শকাতর হওয়ায় তা জনসমক্ষে আনা সম্ভব নয়। আজ বৈঠকের শুরুতেই এ নিয়ে জানতে চান বসু পরিবারের সদস্যরা। বৈঠকে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এবং বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে রাজনাথের কাছে ব্যাখ্যা চাইলে তিনিজানান, কমিশন ওই ফাইলগুলি খতিয়ে দেখছে। তার পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে বৈঠক শেষে বসু পরিবারের সদস্যদের আশ্বাস দিয়ে ও পরে টুইট করে মোদী বলেন, ‘‘আগামী বছর ২৩ জানুয়ারি, নেতাজি সংক্রান্ত ফাইলগুলি প্রকাশ্যে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হবে।’’
আজকের বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও, সরকারের এই পদক্ষেপকে ‘ইতিবাচক’ বলে বর্ণনা করেছেন নেতাজির মেয়ে অনিতা বসু পাফ। ভিয়েনা থেকে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘দেরিতে হলেও যে এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া গিয়েছে, সেটাই ভাল। সত্তর বছর আগে কী হয়েছিল, তার জন্য এখনকার সরকারকে কেউ যে দোষ দেবে না, এটা সকলের বোঝা উচিত।’’ বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বে তিনি বিশ্বাস করেন কি না জানতে চাওয়া হলে অনিতাদেবী বলেন, ‘‘অবিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখিনি। তবে ফাইলে উল্টো কথা আছে কি না, জানি না।’’ অন্যান্য দেশেও নেতাজি সংক্রান্ত যা ফাইল রয়েছে, সেগুলিও জনসমক্ষে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন নেতাজি-কন্যা।
কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান নেতাজির ভাইপো শিশিরকুমার বসুর স্ত্রী, প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু। তবে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কেন্দ্র যদি ফাইল প্রকাশ করতেই চায়, তা হলে সেটা আরও ৩ মাস ঝুলিয়ে রাখছে কেন?’’ একই সুরে তৃণমূলের ইতিহাসবিদ-সাংসদ সুগত বসুও বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাত্র সাত দিনের মধ্যে সমস্ত ফাইল প্রকাশ করে সেগুলিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করেছে। কেন্দ্রের পক্ষেও তা সম্ভব। তার বদলে ২৩ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে পরবর্তী এক বছর ধরে তা প্রলম্বিত করা অর্থহীন।
আশা করব, যে সমস্ত ফাইল কেন্দ্রের কাছে আছে, সে সবই প্রকাশ করে দেওয়া হবে।’’
ফাইল প্রকাশকে অবশ্য ‘নীতিগত ভাবে ভাল সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন সুগতবাবু। হার্ভার্ড থেকে ফোনে তিনি বলেন, নেতাজি-সংক্রান্ত ফাইল চেয়ে ভারত সরকারের তরফে আগেও রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। সে কথা তিনি জেনেছিলেন আমেরিকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রণেন সেনের কাছ থেকে। সুতরাং ডিসেম্বরে মোদীর সফর শুরু হওয়ার অপেক্ষা না করে এখন থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা যেতে পারে বলে সুগতবাবু মনে করেন।
আজকের বৈঠক উপস্থিত ছিলেন নেতাজি-গবেষক অনুজ ধর। তাঁর মতে, অতীতে পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা ও বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কার কথা বলে নেতাজি-ফাইল প্রকাশ করা থেকে পিছিয়ে এসেছিল কেন্দ্র। সে দিক দিয়ে আজকের ঘোষণা ইতিবাচক। তবে শেষ পর্যন্ত কোন কোন ফাইল সামনে আসবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই গেল।
তৃণমূলের দাবি, নেতাজি-ফাইল প্রকাশের ঘোষণা ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না মোদীর। বিষয়টি নিয়ে সংসদে দীর্ঘ সময় ধরে সরব থাকা তৃণমূলের সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ের দাবি, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাপে আজ মোদীকে ফাইল প্রকাশের বিষয়ে মুখ খুলতে হয়েছে। না হলে তিনিও তো এত দিন মুখ বন্ধ করেই বসেছিলেন।’’ পাল্টা যুক্তি দিয়ে বিজেপির সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, ‘‘গত চার বছর কেন চুপ করে ছিল মমতা সরকার? মোদী তৎপর হওয়ায় এখন তড়িঘড়ি ফাইল প্রকাশ করেছে নবান্ন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy