তপন মিশ্র। বুধবার আমদাবাদে। পিটিআই
তাঁর গবেষণাই কি তাঁর শত্রু!
প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে একাধিক বার। কখনও খাবারে বিষ মিশিয়ে। কখনও পরীক্ষাগারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। কখনও ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কেউটের মতো বিষধর সাপ। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো)-এর শীর্ষ স্তরের বিজ্ঞানী তপন মিশ্রকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল বেশ কিছু দিন আগেই। অবশেষে অবসরের মুখে দাঁড়িয়ে ইসরোর স্বার্থ ও নিজের তথা পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে মুখ খুললেন তিনি। তপনবাবু আজ ফোনে বলেন, “বিরুদ্ধ পক্ষের লক্ষ্যই ছিল আমাকে শেষ করে ইসরো-কে দুর্বল করা। কারণ, ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রেডার ইমেজিং স্যাটেলাইটের ব্যবহারে বিদেশি সংস্থার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। সম্ভবত সেই কারণেই আমাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়।”
রহড়া-নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র তপনবাবুর অভিযোগ, “কিছু বিদেশি গুপ্তচর সংস্থা রয়েছে এর পিছনে। সঙ্গে রয়েছে দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী।” ইসরোর সঙ্গে জড়িত ওই দেশবিরোধীদের খুঁজে বার করে তাদের শাস্তির দাবি তুলেছেন এই বিজ্ঞানী।
ভারতীয় বিজ্ঞানীদের রহস্যমৃত্যু নতুন ঘটনা নয়। তপনবাবু গত কাল তাঁর ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “আমরা মাঝে মাঝেই ১৯৭১ সালে বিক্রম সারাভাইয়ের রহস্যমৃত্যুর কথা শুনতাম। ১৯৯৯ সালে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের অধিকর্তা এস শ্রীনিবাসননের মৃত্যু ঘিরে সংশয় ছিল। ১৯৯৪ সালে বিজ্ঞানী শ্রী নাম্বিনারায়ণনের মৃত্যুর ঘটনা সকলের জানা। কিন্তু আমি কোনও দিন ভাবিনি যে, আমার জীবনেও এই রকম ঘটনা ঘটবে।”
তপনবাবু জানাচ্ছেন, ২০১৭ সালে তিনি যখন বেঙ্গালুরুতে ইসরোর প্রধান কার্যালয়ে পদোন্নতি সংক্রান্ত ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন, সে সময়ে তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যার চক্রান্ত হয়েছিল। তপনবাবুর দাবি, সম্ভবত ধোসার চাটনিতে ওই বিষ মেশানো হয়েছিল। পরে তদন্তকারী অফিসারেরা তাঁকে জানান, তাঁর খাবারে আর্সেনিক ট্রাই-অক্সাইড মেশানো হয়েছিল। যার ফলে দীর্ঘ দু’বছর ধরে তাঁকে চর্মরোগ, হাত-পায়ের নখ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, স্নায়ুর সমস্যা ও পেটের সমস্যায় ভুগতে হয়। আমদবাদ, মুম্বই ও দিল্লির এমস হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
এমনই অবস্থা বিজ্ঞানী তপন মিশ্রের পায়ের। ছবি: ফেসবুক
এখানেই শেষ নয়, তাঁর মুখ বন্ধ রাখতে ২০১৮-তে আমদাবাদে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর গবেষণাগার। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তপনবাবু। ২০১৯ সালে ফের হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাসের মাধ্যমে তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয় বলে দাবি করেছেন তিনি। প্রাণনাশের চেষ্টার পাশাপাশি ভুয়ো ভিডিয়ো তৈরি করে চরিত্রহননেরও চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ তপনবাবুর।
চলতি মাসেই অবসর নিচ্ছেন এই বিজ্ঞানী। তিনি কেবল নন, স্ত্রী ও পরিবারের অন্যদেরও একাধিক বার প্রাণনাশের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ইতিপূর্বে। সরকারি আবাসনে মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ত কেউটের মতো বিষধর সাপ।
এত দিন চুপ থাকলেও অবসরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মুখ খোলা প্রয়োজন মনে করছেন তপনবাবু। তাঁর কথায়, “অবশ্যই কিছু ব্যক্তি ইসরোর ক্ষতি করতে চাইছে। সংস্থার দু’হাজার বিজ্ঞানীকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি দেওয়াটাই সমাধান। কারণ, যে ভাবে প্রাণনাশের চেষ্টা করা হচ্ছে, তা থেকে স্পষ্ট, প্রশিক্ষিত কোনও বিদেশি গুপ্তচর সংস্থা ইসরোয় মিশে রয়েছে। তাদের সঙ্গে সংস্থার লোকেদের যোগাযোগ রয়েছে।”
তাঁকে বিষ দিয়ে মারতে চাওয়ার পিছনে তাঁর গবেষণাই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তপনবাবু। তাঁর ব্যাখ্যা, রেডার ইমেজিং স্যাটেলাইট বা রিস্যাট গবেষণায় তাঁর অবদানের কারণে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের ছবি দিনের মতো রাতেও দেখা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে দেশের সেনা বা গুপ্তচর সংস্থা এখন পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে কোনও সময়ে, এমনকি মেঘলা আকাশেও ছবি তুলতে পারে। এর ফলে আমেরিকা, রাশিয়া ও ইজরায়েলের মতো দেশের যে সব সংস্থা ভারতকে ওই প্রযুক্তি দশ গুণ দামে বিক্রি করছিল, তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়।”
তপনবাবুর আশঙ্কা এই দেশগুলির মধ্যে যে কোনও একটি দেশের গুপ্তচর সংস্থা স্থানীয় মদত নিয়ে তাঁকে মারার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরাসরি কোনও দেশের নাম না-করলেও, ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ২০১৭ সালের বিষক্রিয়ার পরে আমেরিকার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান বিজ্ঞানী তাঁর সঙ্গে দেখা করে, বিষয়টি নিয়ে মুখ বন্ধ রাখার ‘নির্দেশ’ দেন। কিন্তু তিনি তা না-করায় চাকরির ক্ষেত্রে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে চলেছে প্রাণনাশের চেষ্টা।
তপনবাবু আজ জানান, গোড়া থেকেই তিনি হামলার ঘটনাগুলি সম্পর্কে পুলিশকে জানিয়ে রেখেছেন। বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যের কারণে তাঁর প্রাণরক্ষাও হয়েছে। সেই ভরসাতেই এ যাত্রায় মুখ খুলেছেন তিনি। তাঁর আশা, তদন্তকারী সংস্থা দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy