প্রাণ বাঁচাতে এই ধরনের বাঙ্কারই এখন ভরসা সুমিতে আটকে থাকা ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের। নিজস্ব চিত্র।
এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ। পানীয় জল, বিদ্যুৎ সংযোগ কিছুই নেই। ইন্টারনেট সংযোগ খুব খারাপ, মাঝে মাঝেই নেট চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি প্রতিটা দিন আরও খারাপ হচ্ছে। আমি যে ফোন থেকে এখন কথা বলছি, তার চার্জও ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। মোবাইল এক বার অফ হয়ে গেলে বাড়িতেও আর যোগাযোগ করতে পারব না। সব চেয়ে বড় কথা, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যে অবস্থার মধ্যে আটকে আছি, সেখান থেকে হয়তো আর কোনও দিনই জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারব না। এই সব কথা ভাবলে ভয় লাগছে, মোবাইলটা অফ করে দিচ্ছি।
আমায় বন্ধুরা ডাকে দেবান বলে। কেরলের কুন্নুরের বাসিন্দা। অনেক আশা নিয়ে ডাক্তারি পড়তে অন্য দেশে এসেছিলাম। ইউক্রেনের সুমি স্টেট ইউনিভার্সিটির পঞ্চম বর্ষের ডাক্তারি পড়ুয়া আমি। দেশের বাড়িতে বয়স্ক মা-বাবা। আমি ছাড়া ওঁদের দেখার কেউ নেই। তা-ও ওঁদের ছেড়ে, নিজের দেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ অচেনা একটা দেশে, অন্য একটা পরিবেশে মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়তে এসেছিলাম পাঁচ বছর আগে। আমার মা-বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল আমায় ঘিরে। ভেবেছিলাম, কোর্স শেষ করে দেশে ফিরে যাব, মা-বাবার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাব। একদম শেষে এসে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আমার মেডিক্যাল ডিগ্রির জন্য এত লড়াই, এত কষ্ট। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে ভাবার মতো মনের অবস্থাও আর নেই। এখন শুধু মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচব তো? আমার কিছু হয়ে গেলে ওঁরা কী করবেন, ভাবতেও ভয় লাগছে।
যখনই বাড়িতে ফোন করছি, ওঁদের সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় কথা বলার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি, যাতে ফোনে কথা বলার সময়ে আমার গলায় ভয়, কোনও অস্বাভাবিক উৎকণ্ঠা ধরা না পড়ে। কারণ, মা-বাবা আমায় নিয়ে যতটা ভয় পেয়ে রয়েছেন, যে ভাবে প্রতি সেকেন্ডে দুশ্চিন্তা করছেন, তার উপরে আমি যদি নিজের ভয় প্রকাশ করি, ওঁরা পাগল হয়ে যাবেন। নিজের ছেলের থেকে এত হাজার মাইল দূরে বসে ওঁদের পক্ষে কিছু করাও সম্ভব নয়। তা-ও প্রতি দিন চেনাশোনা লোকেদের কাছে, সরকারি আধিকারিকদের কাছে ছোটাছুটি করছেন ওঁরা। যদি আমাদের কোনও ভাবে এখান থেকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা তরান্বিত করা যায়, সেই চেষ্টা করে চলেছেন আমার অসহায় মা-বাবা।
একই রকম অসহায় অবস্থা আমার। সুমি শহরে আমাদের এই মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট। এখানে ইউনিভার্সিটির হস্টেলে প্রায় সাতশো জন ভারতীয় পড়ুয়া আটকে রয়েছি। তাঁরা আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাসিন্দা। শহরের আকাশে মাঝেমধ্যেই বিমান হামলা চলছে। তিন তারিখেও এখানে বোমা পড়েছে, আমাদের হস্টেল থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। সে সময়ে গোটা হস্টেল কেঁপে উঠেছিল। যখনই যুদ্ধের আলার্ট বাজছে, আমরা বাঙ্কারে চলে যাচ্ছি। দিনের মধ্যে তিন- চার ঘণ্টা ওখানে কাটাচ্ছি, তার বেশি পারছি না। বাঙ্কারে বেশি ক্ষণ কাটানো যায় না, দম বন্ধ হয়ে আসে। খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ওখানে। তাই হস্টেলে ফিরে আসছি সবাই।
এখানে এখন মাইনাস তিন-চার ডিগ্রি তাপমাত্রা। রাতের দিকে সেটা আরও কমে যায়। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত শীতপোশাক, কম্বল-চাদরটুকুও নেই। এত জন ছাত্রছাত্রীর খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই। কোনও দিন ভাত-পাঁউরুটি জুটছে, কোনও দিন সেটুকুও নয়। বিস্কুট আর চিপস খেয়েই দিন কাটছে আমাদের। এখন আর তিন-চার দিনের মতো খাবার মজুত রয়েছে। জানি না, এর মধ্যে আমাদের উদ্ধারকাজ শুরু না হলে এর পরে কী হবে।
এখনও অবধি মন শক্ত রেখেছি। শরীরের শক্তি অনেক আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে। শুধু মন শক্ত রেখে লড়ে যাচ্ছি। রাতের পর রাত ঘুম নেই। চেষ্টা করেও ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে, কখন বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে একটু নির্ভাবনায় ঘুমোতে পারব, যেখানে কোনও বিমান হামলা নেই, যেখানে কোনও গোলাগুলির শব্দ নেই, যেখানে প্রতিটা সেকেন্ডে মরে যাওয়ার ভয় নেই। যত বার ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, আমাদের বার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করছি, বলা হচ্ছে অপেক্ষা করতে। দশ দিন ধরে বাঙ্কারে লুকিয়ে আছি। গোলাগুলি, বোমার শব্দের মধ্যে দিন-রাত কাটছে। আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?
আমাদের শহর ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত। এখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার সীমান্ত। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড বা রোমানিয়ার মতো যে সব দেশের সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া ভারতীয় পড়ুয়াদের দেশে ফেরানোর উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে ভারত সরকার, সেখানে আমাদের নিজেদের দায়িত্বে পৌঁছনো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। আমরা হস্টেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গেলেই গুলি চলছে। তার সঙ্গে এয়ার স্ট্রাইক তো আছেই। চার দিকে ধ্বংসস্তূপ। তার উপরে রাস্তায় পুরু বরফ পড়ে আছে। প্রাণ বাঁচিয়ে নিজের দায়িত্বে কোথাও যাওয়া অসম্ভব।
আমরা যে এত জন এখানে আটকে রয়েছি, ইউক্রেনের সরকারি কোনও আধিকারিক বা উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তিদের সাহায্য আমরা পাইনি। কেউ এক বার খোঁজও নেননি। তবে কো-অর্ডিনেটরেরা খাবার জোগাড় করে দিচ্ছেন সাধ্যমতো।
শনিবার সকালে তিতিবিরক্ত হয়ে আমরা ঠিক করেছিলাম, হস্টেল ছেড়ে বেরিয়ে সীমান্তের দিকে হাঁটা দেব। যা হয় হোক, চেষ্টা করব নিজেরাই। আমাদের কিছু হলে দায়ী থাকবে আমাদের দেশের সরকার। কিন্তু অভিভাবকেরা প্রাণের ঝুঁকি নিতে বারণ করছেন। তাই আমরা আবার হস্টেলে ফিরে এলাম। ২৪ তারিখ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। মাঝে দশ দিন কেটে গিয়েছে। আমরা এখনও অপেক্ষা করে চলেছি।
(লেখক: সুমি স্টেট ইউনিভার্সিটির পঞ্চম বর্ষের ডাক্তারি পড়ুয়া)
অনুলিখন: চৈতালি বিশ্বাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy