Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
আবার অশান্ত কাশ্মীর। জঙ্গি হানা চলছেই। আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখল করার পর কাশ্মীরের পরিস্থিতি পর্যালোচনা
Article 370

Article 370: ৩৭০ প্রত্যাহারের পরেও উন্নয়ন আর হল কই

আবার অশান্ত কাশ্মীর। জঙ্গি হানা চলছেই। আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখল করার পর কাশ্মীরের পরিস্থিতি পর্যালোচনা

ফের অশান্ত হয়ে উঠছে কাশ্মীর।

ফের অশান্ত হয়ে উঠছে কাশ্মীর। ফাইল চিত্র।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
শ্রীনগর শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২১ ০৭:৫২
Share: Save:

কেমন আছেন?

প্রথমে চুপ করে রইলেন। তারপরই উগরে দিলেন রাগ।

সোনমার্গের আজিজ খানের কথায়, ‘‘ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছি আমরা। আগে একটা সময় লড়াই ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য। আজ সেই আমরাই রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করছি। দেশের অন্য সব রাজ্য যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা অন্ধকারে ডুবে রয়েছি।’’ এমএ এবং এমবিএ ইজাজ চাকরি করেন একটি হোটেলে, বেতন পান কুড়ি হাজার টাকা। শীত পড়তেই পাড়ি দেন গোয়ায়। সেখানেই হোটেলের চাকরিতে কেটে যায় বছরের বাকি ছয় মাস।

বাড়ি যান না ? উদাস আজিজ বলেন, ‘‘টাকা রোজগার করা খুব দরকার। বাড়িতে অনেক লোক। আমার রোজগারেই চলে। তবে তার চেয়েও বড় কারণ, গ্রামের লোকের কাছে আমি এখন ঘৃণার পাত্র। কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমি এলাকায় বিজেপির পোলিং এজেন্ট ছিলাম। ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পরে স্থানীয় লোকেদের চোখে আমি অপরাধী। বাড়ি গেলে প্রতিবেশীরা আমায় এড়িয়ে যান। তাই যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি।’’ ইজাজের আফসোস, বছর দু’য়েক আগে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা লোপের পরে যদি উন্নয়ন হত, চাকরির সুযোগ বাড়ত, তা হলে হয়তো ছবি পাল্টে যেত। ইজাজের কথায়, ‘‘যদি সোনমার্গকেই পর্যটনবান্ধব এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা যেত, অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত এই এলাকা। কিন্তু কোথায় কী!’’

যদিও কেন্দ্রের দাবি, ২০১৫ সালে ঘোষিত কেন্দ্রীয় প্যাকেজের ৮০ হাজার কোটি টাকার ‘উন্নয়ন যজ্ঞ’ শুরু হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরে। যে কাজের তদারকি করতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ঘুরিয়েফিরিয়ে কাশ্মীর যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত মাসে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। অক্টোবরেই আসার কথা রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের। সে ক্ষেত্রে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর ভূস্বর্গে এই প্রথম পা পড়বে শাহের।

রাজনীতির অনেকেই মনে করেন, বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরে টানা ‘সেনাশাসন’ কাশ্মীরবাসীকে নুইয়ে দিয়েছে। নষ্ট করে দিয়েছে আত্মপ্রত্যয়। লাগাতার ধরপাকড়ে বসে গিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। না হলে রয়েছেন গৃহবন্দি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতাশ কাশ্মীরবাসী। অভিযোগ, বেড়েছে গুম-খুন। জঙ্গি দমনে প্রবল ভাবে সক্রিয় একাধিক নিরাপত্তা সংস্থা। শ্রীনগরে বাস চালান মকবুল। তাঁর কথায়, ‘‘নব্বইয়ের দশকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হত কাশ্মীরিদের। তার পর তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যেত না। এখন আবার ওই ধরনের ঘটনা বেড়ে গিয়েছে। কে কত জঙ্গি নিকেশ করতে পারে, সেই লড়াই চলছে এজেন্সিগুলোর মধ্যে। কাশ্মীরের এক প্রান্ত থেকে সন্দেহভাজনদের তুলে নিয়ে অন্য প্রান্তে এসে হত্যা করা হচ্ছে বলে শুনছি আমরা অনেকেই।’’

এর পরেও কি মিটেছে জঙ্গি সমস্যা? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হিসেবে, শুধু দক্ষিণ কাশ্মীরেই এখনও সক্রিয় রয়েছে প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি জঙ্গি। যাদের অর্ধেকের বেশি স্থানীয়। প্রশাসনের কাছে চিন্তার বিষয় হল, ফি দিন নতুন যুবকেরা নাম লেখাচ্ছেন জঙ্গি দলে। তার সঙ্গে বাড়তি সংযোজন আফগানিস্তান। যে কারণে জঙ্গি দলে নাম লেখানোর প্রবণতা যে বেড়েছে তা মেনে নিচ্ছেন নিরাপত্তা আধিকারিকদের একাংশ। অন্য দিকে, জঙ্গি দমনের নামে ‘কড়াকড়িতে’ ক্ষুব্ধ নাগরিকরা। ডাল লেকে নিত্য দিন শিকারা নিয়ে বেরোন ইয়াকুব। পৈতৃক বাড়ি জঙ্গি অধ্যুষিত বারামুলায়। তাঁর কথায়, ‘‘জঙ্গিরা কারও বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিলে শুরু হয় অভিযান। এক জনকে মারতে অন্তত শখানেক সেনা যান। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু জঙ্গি আত্মসমর্পণ না করলেই, গোটা বাড়ি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সারা জীবনের সঞ্চয় গুঁড়িয়ে যায় এক বিস্ফোরণে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে গেলে দাগিয়ে দেওয়া হয় জঙ্গির সহমর্মী হিসেবে।’’

দিনের শ্রীনগর দেখলে অবশ্য এই চাপা ক্ষোভ আর উত্তেজনা বোঝার উপায় নেই। করোনা সংক্রমণের ভয় পেরিয়ে খুলে গিয়েছে দোকান-পাট, সরকারি দফতর, স্কুল। গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক। কাশ্মীরগামী প্রতিটি বিমানের আসন ভর্তি। থিকথিকে ভিড় বিমানবন্দরের করোনা পরীক্ষা কাউন্টারে। যাঁদের অধিকাংশ পর্যটক। শুরু হয়েছে বলিউডের শুটিং-ও। স্বাভাবিক লাল চক, ডাল লেক চত্বর। সকালের আলো ফুটতেই ডাল লেকে শিকারা ভাড়া করা নিয়ে পর্যটকদের সঙ্গে দরদামের চেনা ছবি। রয়েছেন সেনারাও। রাস্তায় গাছের ছায়ায় অলস ভাবে দাঁড়িয়ে জলপাই উর্দিধারীরা। পাশে দাঁড়ানো সাঁজোয়া গাড়িটিও যেন ঝিমিয়ে রয়েছে। যদিও, চিত্র সাংবাদিক তৌসিফের কথায়, ‘‘কোনও সন্দেহজনক গতিবিধির খবর আসুক না, দেখবেন মুহূর্তে কেমন পাল্টে যাবে ছবিটা। এক ঝটকায় কাঁটাতার ফেলে, রাস্তা বন্ধ করে শুরু হয়ে যাবে তল্লাশি। আমজনতাকে বাধ্য করা হবে ঘরে ঢুকে যেতে। ঝাঁপ পড়ে যাবে দোকানের। বন্ধ হয়ে যাবে স্কুল। নেটওয়ার্ক উড়ে যাবে মোবাইলের। জনে-জনে ধরে ধরে শুরু হবে তল্লাশি। তখন কাশ্মীরকে খুঁজে পাবেন তার অতীতের চেহারায়।’’

বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার কাশ্মীরবাসীর মনে গভীর ক্ষত তৈরি করলেও, শ্রীনগরের বিজেপি কর্মী বিক্রম রায়নার দাবি, ‘‘৩৭০ ধারা বহু আগেই প্রত্যাহার হওয়া উচিত ছিল। এর ফলে কারা সন্ত্রাসের সঙ্গে আর কারা দেশের পক্ষে রয়েছেন তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। যে রাজনৈতিক নেতারা দিনে ভারতের পক্ষে কথা বলে। রাতে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিতেন, তাঁদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। পাক মদতের সাপ্লাই লাইন কেটে দেওয়ায় পাথর ছোড়া থেকে জঙ্গি তৎপরতা সব কিছুই কমে গিয়েছে। দু’নৌকায় পা দিয়ে চলা বন্ধ হয়েছে উপত্যকার রাজনৈতিক নেতাদের।’’

রায়নার আশা, খুব দ্রুত জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা আসন পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ হবে। তারপরে ভোটে জম্মুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয়লাভের সুযোগে উপত্যকা শাসন করবে বিজেপি। বিজেপির এই পরিকল্পনা যে দীর্ঘ দিনের এবং নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ তা পূরণ করতে বদ্ধপরিকর বলে মনে করছেন শ্রীনগরে ন্যাশনাল কনফারেন্স দলের এক নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতার কথায়, ‘‘যে ভাবে ধাপে ধাপে কেন্দ্র পদক্ষেপ করেছে, তা থেকে স্পষ্ট বিজেপি চাইছে উপত্যকার চরিত্রকে পাল্টে দিতে। কাশ্মীরিয়ত— যা আমাদের নিজস্ব সত্তা ছিল তা নষ্ট করে দিতেই ওই পদক্ষেপ।’’ রায়নার পাল্টা যুক্তি, নব্বইয়ের দশকে যখন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকায় খুন করে, প্রাণের ভয় দেখিয়ে ভিটেছাড়া করা হয়েছিল, তখনই মেরে ফেলা হয়েছিল কাশ্মীরিয়তকে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের লক্ষ্য সেই সত্তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, এমন আবহ তৈরি করা যেখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy