মনমোহন সিংহ। —ফাইল চিত্র।
ওঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরা যাই বলুন, আমার তাঁকে কখনওই মৌন বলে মনে হয়নি। বরং তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা আকছার নির্ভেজাল ‘বাঙালির আড্ডা’ হয়ে উঠত। মৃদুভাষী মনমোহন সিংহ নানা বিষয়ে অনর্গল কথা বলতেন। আমি সাংসদ থাকাকালীন এক বার আমি, মা (প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু) এবং উনি নৈশভোজে বসেছিলাম। তখন উনি শুধুই রাজ্যসভার সাংসদ। মনে আছে, উনি বলেছিলেন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর জট বা তিক্ততা ওঁর সময়ে প্রায় মুছে ফেলতে পেরেছিলেন। পাক প্রেসিডেন্ট মুশারফের হঠাৎ পতনে সব গোলমাল হয়ে গেল।
মনমোহন সিংহের অর্থনৈতিক সংস্কার বা আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে অবদান নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে মুগ্ধ, তবে পড়শি দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে ওঁর তাগিদও আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে মনমোহন অটলবিহারী বাজপেয়ীর নীতিরই অনুসারী ছিলেন।
মনমোহন বার বার ‘সফট বর্ডার’ বা নমনীয় সীমান্তের কথা বলতেন। সীমান্ত থাকলেও তা যেন সহজেই পারাপার করা যায়। কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পারে সাধারণ মানুষের চলাচল সহজ করার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে ‘ব্যাক চ্যানেলে’ সতিন্দর লাম্বার মতো কূটনীতিকদের মাধ্যমে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে এর জন্য দরকারি জনমত গড়ার কাজটা তখনও শেষ করতে পারেননি। তার আগেই পাকিস্তানে পালাবদল ঘটে। আজ ভারতের সঙ্গে বেশির ভাগ পড়শি দেশের সম্পর্কে অবনতির দিনে মনমোহনের চেষ্টার কথা খুব মনে পড়ে।
সমালোচনা শোনার খোলা মনটাও ছিল মনমোহনের। লাইসেন্স রাজ, পারমিট রাজ দূর করার কৃতিত্ব মনমোহন বা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওকে দিতেই হবে। তবে অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে আমাদের অনেকের আক্ষেপ ছিল, প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে উনি ততটা গুরুত্ব দেননি। এ সব সমালোচনায় মনমোহন নির্বিকার ছিলেন বলে মনে হয় না। ১৯৯৬ সালের বাজেটেই শিক্ষাখাতে তিনি তিন গুণ অর্থ বাড়িয়েছিলেন।
মার্জিত, বিনয়ী, অধ্যাপকসুলভ মানুষটির বাড়িতেও সবার মাঝে দেখলে ওঁকে প্রধানমন্ত্রী বলে মনেই হত না। আমাদের হার্ভার্ডের সহকর্মীদের নিয়ে গিয়েও ওঁর অসামান্য আদর, যত্ন পেয়েছি। ক্ষমতার দম্ভহীন এমন মানুষ বিরল। ওঁর এক কন্যা উপিন্দর আমাদের বন্ধুস্থানীয়, ইতিহাসবিদ। আমার সঙ্গে দেখা হলে, মনমোহন ইতিহাসের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাম্প্রতিক কাজকর্ম নিয়েও জানতে চাইতেন। মা (কৃষ্ণা) সাংসদ থাকাকালীন সংসদের অ্যানেক্সিতে এক জন ফিজিয়োথেরাপিস্টের কাছে ওঁর হাঁটুর শুশ্রূষার জন্য আমরা প্রায়ই যেতাম। মনমোহনও সেখানে আঙুলের ব্যথার উপশমের জন্য যেতেন। দেখা হলেই সুন্দর গল্প হত। আর মনমোহন সব সময়েই মাকে আগে দেখিয়ে নিতে বলতেন। আমার কাছে এটাই মানুষ মনমোহনের পরিচয়।
উনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছু দিন বাদে মনমোহন ও তাঁর স্ত্রী গুরশরণের নেতাজি ভবনে সফরও আমার মনে খোদাই হয়ে আছে। হরিপুরা কংগ্রেসে নেতাজির একটা ছবি ওঁরা খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। নেতাজিকে স্বর্ণমন্দির থেকে তরবারি পাঠানো হয়েছিল, তা নিয়ে জানতে উৎসুক ছিলেন গুরশরণ। আর মনমোহন নেতাজির বক্তৃতায় ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন নিয়ে ভাবনার দিকেই রীতিমতো আকৃষ্ট হন। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নন, আগামী ভারতের এক দিশারী সুভাষচন্দ্রই তখন ওঁর মন জুড়ে ছিলেন।
(লেখক: প্রাক্তন সাংসদ, ইতিহাসবিদ ও নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর চেয়ারপার্সন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy