ঘড়িতে তখন প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। কলকাতা বিমানবন্দরের কার্গো চার নম্বর গেটের বাইরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে শববাহী গাড়ি, কলকাতা পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্স। তার বেশ কিছু ক্ষণ আগেই বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছিলেন বেহালার শখেরবাজারের বাসিন্দা সমীর গুহের পরিজনেরা। ছিলেন বৈষ্ণবঘাটার বাসিন্দা বিতান অধিকারীর আত্মীয়েরাও। কখন বিমান নামবে, সেই অপেক্ষা যেন শেষ হতে চাইছিল না কারও। অবশেষে ৭টা ৩৪ মিনিটে অবসান হয় অনন্ত প্রতীক্ষার।
সমীরের মরদেহবাহী গাড়ির সঙ্গে ছিল মেয়র ফিরহাদ হাকিমের গাড়ি। অন্য দিকে, বৈষ্ণবঘাটার বাসিন্দা বিতান অধিকারীর মরদেহ নিয়ে বেরোন অগ্নিমিত্রা পাল। তাঁর কোলে ছিল বিতানের সাড়ে তিন বছরের ছেলে হৃদান। সঙ্গে ছিল মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের গাড়ি। রাত ৯টা ১০ মিনিটে শখেরবাজারের বাড়িতে পৌঁছয় সমীরের দেহ। সেখানে তখন ভেঙে পড়েছে গোটা এলাকা।
পাড়ায় যে ক্লাবের সদস্য ছিলেন সমীর, সেখানকার পুজো মণ্ডপে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ক্লাবের এক সদস্য বাবু চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘নানা অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। গত বছরও চাঁদা তুলতে গিয়েছিলেন।’’ সমীরদের এক প্রতিবেশী শম্পা মিত্র বলেন, ‘‘খুব ভাল পরিবার। পাড়ার লোকের বিপদে সব সময়ে পাশে পেতাম ওঁকে।’’
একই চিত্র দেখা যায় বৈষ্ণবঘাটা লেনের বাড়িতে বিতানের দেহ পৌঁছনোর পরে। সেখানে তাঁকে শেষ বিদায় জানান পাড়ার লোকজন। বিতানের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢোকেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
আত্মীয় থেকে শুরু করে পড়শিরা এখনও বিশ্বাসই করতে পারছেন না, পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়ে বাড়ির লোক কফিনবন্দি হয়ে ফিরবেন। মঙ্গলবার ভূস্বর্গে জঙ্গিদের হত্যালীলার আতঙ্ক এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁদের। একই ছবি পুরুলিয়ার ঝালদা শহরের পুরনোবাঘমুণ্ডি এলাকায়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার খবর শোনার পর থেকে বার বার সমীরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন আত্মীয়েরা। কিন্তু, সব চেষ্টাই বিফলে যায়। কোনও ভাবেই যোগাযোগ করতে না পারায় উদ্বেগের সঙ্গে ঘনাচ্ছিল খারাপ কিছু ঘটার আশঙ্কার মেঘও। রাত তিনটের সময়ে আসা একটি ফোন সেই আশঙ্কাই সত্যি করে। বুধবার বাড়িতে বসে সমীরের শ্যালক সুব্রত ঘোষ বললেন, ‘‘যে গাড়িতে করে দিদি-জামাইবাবুরা ঘুরছিলেন, সেটির চালক আমাকে ফোন করে জানান, জঙ্গিদের গুলিতে মারা গিয়েছেন জামাইবাবু। তবে, দিদি এবং মেয়ে ঠিক আছে। এর বেশি তিনি আর কিছু বলতে পারেননি।’’
শখেরবাজারে চণ্ডী মন্দিরের কাছে একটি আবাসনের দোতলায় স্ত্রী শর্বরী ও একমাত্র মেয়ে শুভাঙ্গীকে নিয়ে থাকতেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী সমীর। মেয়ের দ্বাদশের বোর্ডের পরীক্ষা শেষ হলে সপরিবার কাশ্মীর যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে রওনা দেন গত ১৬ এপ্রিল। আজ, বৃহস্পতিবার তিন জনের ফেরার কথা ছিল। আত্মীয়েরা জানাচ্ছেন, কাশ্মীরে পৌঁছে সেখানকার নানা ছবি পাড়ার বন্ধুদের পাঠিয়েছিলেন সমীর। মঙ্গলবার সকালেও ভাই সুব্রতকে ভিডিয়ো কলে দিদি শর্বরী জানান, তাঁরা পহেলগামের উদ্দেশে যাচ্ছেন। সেই শেষ!
স্বভাবে মিতভাষী সমীর অংশ নিতেন পাড়ার নানা অনুষ্ঠানে। বুধবার সকালে দুঃসংবাদ আসার পরে তাঁর ফ্ল্যাটে ভিড় ভেঙে পড়ে ক্লাবের সদস্য ও প্রতিবেশীদের। স্বপন দাস নামে পাড়ার এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘একটা মানুষ পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়ে যে এ ভাবে কফিনবন্দি হয়ে ফিরতে পারে, বিশ্বাস করাই শক্ত।’’ সমীরের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। সেখান থেকে বেরিয়ে জঙ্গি হামলায় নিহত আর এক বাঙালি বিতান অধিকারীর বেহালার বৈশালী পার্কের বাড়িতে যান তিনি।
মঙ্গলবার রাতে টিভিতে খেলা দেখার ফাঁকে চ্যানেল ঘুরিয়ে ছেলে বিতানের মৃত্যুসংবাদ জানতে পারেন ৮৭ বছরের বৃদ্ধ বাবা বীরেশ্বর অধিকারী। তার পর থেকে কথা বলার অবস্থায় নেই তিনি এবং তাঁর স্ত্রী। আত্মীয়েরা জানালেন, কাজের সূত্রে বছরখানেক আগে ফ্লরিডা গিয়েছিলেন পরিবারের ছোট ছেলে বিতান। তিনিই মূলত বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশোনা করতেন। কয়েক মাস আগে কলকাতায় ফিরে তাঁদের চোখের অস্ত্রোপচারও করিয়েছিলেন। এক আত্মীয় শঙ্কর চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বিতান বিদেশে থাকলেও ওর স্ত্রী ও সন্তান এখানে থাকত। একটা ঘটনায় পুরো সংসারটা ছারখার হয়ে গেল।’’ ঘটনার পর থেকে বার কয়েক বিতানের স্ত্রী সোহিনীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন আত্মীয়েরা। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘সোহিনী শুধু বলছে, আমার তো সব চলে গেল।একসঙ্গে এলাম, ফিরছি ওর কফিনবন্দি দেহ নিয়ে।’’
পহেলগামে জঙ্গি হানায় নিহত হয়েছেন ঝালদার যুবক মণীশরঞ্জন মিশ্র (৪২)। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবি-র এই সেকশন অফিসার হায়দরাবাদে কর্মরত ছিলেন। স্ত্রী জয়া, ১৩ বছরের ছেলে ও সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে হায়দরাবাদ থেকেই সহকর্মীদের সঙ্গে ১৫ এপ্রিল কাশ্মীর রওনা হন। মণীশের ভাই রাহুল বলেন, “ঘটনার পরে বৌদি ফোনে বলেছিল, ‘আমার সামনেই মেরে ফেলল’। পরে খবর পাই, বৌদি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ভাইঝি ও ভাইপোকে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে।’’ তিনি জানান, আজ, বৃহস্পতিবার রাতে রাঁচী বিমানবন্দরে মণীশের দেহ আসার কথা।
আজই মণীশদের সঙ্গে বৈষ্ণোদেবী মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর বাবা-মা ও দুই ভাইয়ের পরিবারের। সে জন্য মঙ্গলবার তাঁরা ঝালদা থেকে রওনা হয়েছিলেন। রাস্তায় মণীশের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁরা ফিরে আসেন।
সহ প্রতিবেদন: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ঝালদা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)