(বাঁ দিকে) রতন টাটা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে) —ফাইল চিত্র।
সিঙ্গুর থেকে ন্যানোর কারখানা সরিয়ে গুজরাতের সানন্দে নিয়ে যাওয়ার সময় রতন টাটা বলেছিলেন, তিনি ‘ব্যাড এম’ (মমতা) ছেড়ে ‘গুড এম’ (মোদী)-কে বেছে নিলেন। বুধবার মধ্যরাতে তাঁর প্রয়াণের অব্যবহিত পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী— দু’জনেই শোকস্তব্ধ। মমতা তাঁর শোকবার্তায় রতন টাটাকে ‘পরোপকারী’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। প্রায় একই ভাবে মোদী রতন টাটার মধ্যে মানবতা, মমতা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকাও স্মরণ করেছেন মোদী।
শুধু মোদী বা মমতা নন, শিল্পপতি রতন টাটার মৃত্যুতে মুহ্যমান দেশ। শোক জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সকলেই এই মৃত্যুকে দেশের শিল্পক্ষেত্রের জন্য অপুরণীয় ক্ষতি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। মমতা তাঁর এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘টাটা গ্রুপের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ছিলেন ভারতীয় শিল্প ক্ষেত্রের সবার আগে থাকা নেতা। একই সঙ্গে ছিলেন সাধারণ মানুষকে উৎসাহদাতা পরোপকারী।’’ আর মোদী এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘এক জন অসাধারণ মানুষ ছিলেন রতন টাটা। তিনি ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্পগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁর অবদান সংস্থার বোর্ডরুমের বাইরেও থেকেছে।’’ সমাজের উন্নতিতেও রতন টাটার অনেক অবদান ছিল বলেও উল্লেখ করেছেন মোদী।
২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসে সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই মতো রাজ্য সরকার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে। কিন্তু, অনেকেই জমি দিতে অস্বীকার করেন। সেই অনিচ্ছুক চাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে নামে সেই সময়কার বিরোধী দল তৃণমূল। ধারাবাহিক সেই আন্দোলনের জেরে অনেক টানাপড়েনের পর টাটা গোষ্ঠী এ রাজ্য থেকে তাদের ন্যানো প্রকল্প তুলে নেয়।
৩ অক্টোবর, ২০০৮। সে দিন ছিল দুর্গাপুজোর চতুর্থী তিথি। দেবীপক্ষে ন্যানো প্রকল্প সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন রতন টাটা। আর ২০২৪-এর দেবীপক্ষে ষষ্ঠীর রাতে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার। মাঝখানে রয়ে গিয়েছে এক বড় অধ্যায়।
২০১১ সালে এই সিঙ্গুর আন্দোলনে ভর করেই রাজ্যের মসনদে বসার পথ প্রশস্ত করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৃণমূল সরকারের প্রথম কাজই ছিল সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দিতে আইন তৈরি করা। মমতার মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল এটাই। সেই বছরেই বিধানসভায় ‘সিঙ্গুর বিল’ পাশ হয়। রাজ্যপাল বিলে সই করে দেন। রাজ্য সরকার ন্যানোর জন্য বরাদ্দ জমি দখল করে। তবে ‘সিঙ্গুর আইন’কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে গেল টাটা মোটর্স। সরকারি নির্দেশে স্থগিতাদেশ চাইল তারা। কলকাতা হাইকোর্ট টাটাদের আর্জি খারিজ করল। অর্ডিন্যান্সে স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় টাটা মোটর্স কর্তৃপক্ষ।
দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে বিশ্বের সব থেকে সস্তার ছোট যাত্রী-গাড়ি তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাড়া ফেলেছিল টাটারা। সেই লগ্নি পেতে প্রতিযোগিতায় নামে বিভিন্ন রাজ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে টাটাদের চুক্তিতে তার আভাসও ছিল। উত্তরাখণ্ড বা হিমালচপ্রদেশের প্রস্তাবিত সমান আর্থিক সুবিধা (১০ বছর ধরে উৎপাদন শুল্কে ছাড়, প্রথম পাঁচ বছরে কর্পোরেট আয়করে পুরো ছাড় ও পরের পাঁচ বছরে ৩০% ছাড়) দিলে, তবে এ রাজ্যে কারখানা গড়ার আশ্বাস দিয়েছিল তারা। যা পরে রাজ্য মেনে নেয়। যদিও একাংশের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে কারখানা গড়তে তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন টাটার ব্যক্তিগত আগ্রহের কথাও শোনা যায়। তবে শেষে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ বিতর্কের মুখে পড়ে টাটা কারখানা সরান সানন্দে। যদিও সেখানে গিয়েও সাফল্য পায়নি ন্যানো। একটা সময়ের পরে ন্যানো তৈরি বন্ধ হয়। তবে সানন্দের কারখানায় অন্য গাড়ি তৈরি করে টাটা।
পরে রাজ্যে এসে বাংলার শিল্প নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন রতন টাটা। ২০১৪ সালে কলকাতায় এসে তিনি বলেছিলেন, বিমানবন্দর থেকে পূর্ব কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে আসার পথে শিল্পায়নের কোনও চিহ্ন তাঁর চোখে পড়েনি। কারখানা বাংলা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময়ে তিনি বলেন, “বলেছিলাম মাথায় বন্দুক ঠেকালেও যাব না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ট্রিগার টিপে দিলেন।” সেই কথা মনে করিয়ে ২০১৪ সালে কলকাতায় বণিক সভার অনুষ্ঠানে রতন টাটা বলেছিলেন, “বলেছিলাম হয় ট্রিগার টিপুন, না হয় বন্দুক সরান। আমি মাথা সরাব না। আজও একই কথা বলছি।”
এ বার তিনি নিজেই সরে গেলেন চিরতরে। বাংলাকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন এখনও অপূর্ণই রয়ে গেল। টিকে রইল শুধু সেই রাজনৈতিক বিতর্ক, ঠিক কাদের জন্য ন্যানো কারখানা বাংলা থেকে গুজরাতে চলে গিয়েছিল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy