ফাইল চিত্র।
আর্যেরা বাইরে থেকে এসে এ দেশে সভ্যতা স্থাপন করেছিল, এই প্রচলিত ধারণা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠে গেল।
মূলত জিনগত গবেষণার মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, হরপ্পা সভ্যতার শেষ পর্যায়ে (খ্রিস্ট-পূর্ব ২০০০) উপমহাদেশে আর্য তথা বহিরাগতদের কোনও আগমন বা আক্রমণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জিনগত প্রমাণের সঙ্গেই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে গবেষকেরা দাবি করেছেন, বৈদিক সভ্যতা আসলে হরপ্পা সভ্যতারই ধারা। হরিয়ানার হিসারের কাছে সরস্বতী অববাহিকায় থাকা রাখিগড়হি এলাকায় হরপ্পা সভ্যতার শেষ পর্বের পুরাতাত্ত্বিক নির্দশন ও দু’টি কঙ্কালের সবিস্তার পরীক্ষার ভিত্তিতে গবেষণাপত্র লিখেছেন ডেকান বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ববিদ বসন্ত শিন্দে, বীরবল সাহনি ইনস্টিটিউট অব প্যালিয়োবোটানির গবেষক নীরজ রাই এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডেভিড রাইখ্। প্রথম সারির আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সেল’-এ গত কাল ওই গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পায়। আজ তা নিয়ে দিল্লিতে মুখ খোলেন বসন্ত-নীরজেরা। যদিও অন্য শিবির বলছে, শুধু একটি প্রত্নস্থলের প্রমাণের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যুক্তিযুক্ত নয়।
গবেষকদের দাবি, শেষ পর্বের হরপ্পা সভ্যতাই হল আদি বৈদিক সভ্যতা। শিন্দের কথায়, ‘‘ঋক-বৈদিক সভ্যতায় সরস্বতী নদীর নাম পাওয়া যায়। রাখিগড়হি ছাড়াও সরস্বতীর অববাহিকার একাধিক অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল। বৈদিক সভ্যতায় যে ভাবে অগ্নিকুণ্ডের বর্ণনা রয়েছে, তার প্রমাণ রাখিগড়হি, কালিবঙ্গানের মতো হরপ্পার সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে পাওয়া গিয়েছে। কচ্ছের কাছে সুরকোটডার ধ্বংসাবশেষে মিলেছে ঘোড়ার হাড়। সুতরাং আর্যেরাই প্রথম ঘোড়া নিয়ে আসে, সেই তত্ত্বও ভুল।’’
যদিও অগ্নিকুণ্ড বা অগ্নিপুজো মানেই হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক সভ্যতার অংশ— এ কথা মানতে রাজি নন অনেকেই। বঙ্গবাসী কলেজের পুরা-নৃতত্ত্বের অধ্যাপিকা প্রিয়দর্শনী সেনগুপ্তের মতে, ‘‘প্রাচীন যুগে বহু সভ্যতাই অগ্নির উপাসক ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় ধর্ম কী ছিল, তা জানা যায়নি। তাই বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে হিন্দু সভ্যতাকে মিশিয়ে দিয়ে সেটিকে হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করা সত্যের অপলাপ।’’ তাঁর মতে, হরপ্পা বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিন্দের খ্যাতি থাকলেও, আগের কোনও গবেষণাপত্রেই তিনি বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পার তুলনা করেননি। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেন তা করা হচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বর্ষীয়ান অধ্যাপিকা। প্রসঙ্গত, আর্যেরা যে বিদেশ থেকে আসেনি, হিন্দুত্ববাদী শিবিরের অনেকেই এই মতকে সমর্থন করে থাকেন।
রাখিগড়হিতে পাওয়া কঙ্কালের জিনগত পরীক্ষা বা ‘জিনোম সিকোয়েন্স’ করা হয়। শিন্দের দাবি, এই পরীক্ষা হরপ্পা গবেষণার ইতিহাসে প্রথম। নীরজের কথায়, ‘‘হরপ্পার জনগোষ্ঠীর মধ্যে মধ্য এশিয়ার কোনও জনগোষ্ঠীর জিন পাওয়া যায়নি।’’ পাল্টা যুক্তিতে ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার বলছেন, ‘‘রাখিগড়হি হরপ্পা সভ্যতার অংশ। আর হরপ্পা যুগে বাইরে থেকে কেউ আসেনি। তাই দেখতে হবে হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী সময়ে বাইরের জনগোষ্ঠীর জিনগত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে কি না। পেলে তা খতিয়ে দেখতে হবে।’’
নীরজ অবশ্য বলছেন, বর্তমানের ভারতীয়দের জিনে ‘হরপ্পান’ জিনের আধিক্য রয়েছে। বহিরাগত আর্যেরা দেশীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেলে মধ্য এশিয়ার জিনের প্রভাব থাকত ভারতীয়দের মধ্যে। কিন্তু তা নেই। খুব সামান্য প্রভাব রয়েছে কুষাণ, শক, হুণ গোষ্ঠীর। রোমিলাদেবীর মতে, এটা ঠিক, নতুন ধাঁচের প্রমাণের ভিত্তিতে ইউরোপের ইতিহাস পাল্টাচ্ছে। তবে নতুন তথ্যের ভিত্তিতে শুরুতেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পরিবর্তে সমস্ত তথ্য ইতিহাসবিদদের সামনে তুলে ধরার পক্ষপাতী তিনি।
ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ মর্টিমার হুইলার প্রথম বলেছিলেন, আর্যেরা বহিরাগত ও তাদের আক্রমণে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। যা খারিজ করে শিন্দে বলছেন, মহেঞ্জোদাড়োর যে কঙ্কাল দেখে হুইলারের এই ধারণা হয়েছিল, পরে প্রমাণ হয়েছে, ওই মানুষগুলির মৃত্যু হয়েছিল বন্যায়। তাই অবিলম্বে ইতিহাস পাল্টানোর পক্ষপাতী শিন্দে। যদিও এই একটি মাত্র প্রমাণের ভিত্তিতে ইতিহাস পাল্টানোতে আপত্তি রোমিলাদেবীর। তাঁর মতে, ‘‘জিনগত যে তথ্য সামনে এসেছে, তা নতুন ধাঁচের প্রমাণ। আগে আলোচনা হয়নি। আগে জিন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে দেখা উচিত, ওই তথ্য কতটা প্রামাণ্য।’’
এ যাবৎ মনে করা হত, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মাঝখানে যে উর্বর চন্দ্রাকৃতি অঞ্চল (ফারটাইল ক্রিসেন্ট) ছিল, সেখান থেকেই ইরানিদের মাধ্যমে ভারতে কৃষিকাজ ছড়িয়ে পড়েছিল। নীরজদের প্রবন্ধে দাবি, উপমহাদেশের কৃষিকাজ স্থানীয়দেরই দান। বাইরের প্রভাব খুব সামান্য। বরং উপমহাদেশের মানুষেরাই নিজেদের কৃষিজ্ঞানকে পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। যদিও ওই তত্ত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্সের গবেষক প্রিয়দর্শী বসুর। তাঁর কথায়, ‘‘সেই সময়ে কারা এ দিকে এসেছিল আর কারা ওই দিকে গিয়েছিল, তা নির্ভুল ভাবে বলা মুশকিল। তবে বর্তমানে আমরা যে সর্ষে ব্যবহার করি তার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার সর্ষের মিল রয়েছে। ফসিল হয়ে থাকা আদি ভারতীয় সর্ষে থেকে যা আলাদা। ফলে মধ্য এশিয়ার প্রভাব ছিল, এই কথা একেবারে খারিজ করা মুশকিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy