ফাইল চিত্র।
প্রথম গানটি গাইলেন দিলীপ কুমারের অনুরোধে। ‘আল্লা তেরো নাম’। এর পরেই, ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ’। রিহার্সাল করার সময়টুকুও পাননি। সঙ্গীত পরিচালক সি রামচন্দ্র সুর করে গানটি টেপ-এ ভরে দিয়েছিলেন। মুম্বই থেকে দিল্লি আসার পথে বিমানে আর হোটেলে পৌঁছে শুধু শুনে গিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। আর তার পরের দিন দিল্লির রামলীলা গ্রাউন্ডে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে দু’টি গান গেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন! ব্যাক স্টেজে গিয়ে আরাম করে এক কাপ কফি নেবেন। কিন্তু দেখেন হন্তদন্ত হয়ে মেহবুব খান তাঁকে ডাকতে এসেছেন। জওহরলাল নেহরু নাকি দেখা করতে চাইছেন। লতা ঘাবড়ে গেলেন। তবে কি কিছু ভুলচুক হল? কোনও মতে নেহরুর সামনে গিয়ে দেখেন, জওহরলালের চোখে চিকচিক করছে জল।
বাকিটা ইতিহাস। আজ লতার প্রয়াণের দিনে বার বার ফিরে আসছে সেই ইতিহাস। তার সঙ্গে এই সত্যও যে, কখনও সক্রিয় রাজনীতিতে না এলেও কেন্দ্রে যে প্রধানমন্ত্রীই থাকুন না কেন— জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, অটলবিহারী বাজপেয়ী হয়ে আজকের নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত, তাঁদের সঙ্গে লতার সখ্য থেকেছে একই রকম। ১৯৬৩ সালের ২৭ জানুয়ারির সেই অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দিল্লির যে বন্ধন তৈরি হয়েছিল, তা চিরঅটুট থেকেছে। অথচ বাজপেয়ী জমানায় তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করা হলেও ছ’বছরের মেয়াদে মাত্র ছ’বার সংসদে গিয়েছেন লতা! এক সাক্ষাৎকারে বলেওছেন যে, সাংসদ হিসাবে তিনি কখনওই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। নিজেও চাননি এই পদ। বলেছিলেন, “আমি রাজনীতির কী বুঝি?” ১৯৯৯ সালের ২২ নভেম্বর থেকে ২০০৫-এর ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজ্যসভার মেয়াদ।
তবে সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা না থাকলেও বাষট্টির চিন-যুদ্ধের পরের ওই অনুষ্ঠানে যে দেশাত্মবোধের বীজ উপ্ত হয়েছিল তাঁর নিজেরই মধ্যে, তা আমৃত্যু প্রবহমান থেকেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই মতে, লতার দেশাত্মবোধকে নিজেদের তৈরি করা জাতীয়তাবাদ এমনকি হিন্দুত্বের প্রসারেও কাজে লাগিয়েছে বিজেপি। আজ এক বিবৃতিতে লালকৃষ্ণ আডবাণী বলেছেন, “অসামান্য রাম ভজন রেকর্ড করে উনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন সেই সময়ে, যখন আমি সোমনাথ থেকে অযোধ্যায় আমার রাম রথযাত্রা শুরু করতে চলেছি। তাঁর সেই গান, ‘রাম নাম মে জাদু অ্যায়সা, রাম নাম মন ভায়ে, মন কি অযোধ্যা তব তক সুনি, যব তক রাম না আয়ে।’ আমার যাত্রার সুর বেঁধে দিয়েছিল এই ভজনগীতিটি।” আডবাণী জানিয়েছেন, বহু অনুষ্ঠানে কৃষ্ণকে নিয়ে ‘জ্যোতি কলস ছলকে’ গানটি গাইতে লতাকে অনুরোধ করতেন তিনি।
আজ সকাল থেকে ধারাবাহিক টুইট করেছেন নরেন্দ্র মোদী। লতার প্রয়াণে ক্যামেরার সামনে দু’কথা বলেছেনও। বিকেলে পৌঁছে গিয়েছেন শেষকৃত্যে। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “লতাদিদির গানে আবেগের বৈচিত্র ছিল। সিনেমার বাইরেও তিনি ভারতের বৃদ্ধি ও উন্নতির প্রশ্নে সর্বদা আবেগদীপ্ত ছিলেন। শক্তিশালী এবং উন্নত ভারতকে দেখতে চাইতেন তিনি। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, কারণ বরাবর তাঁর স্নেহ পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন কখনও ভোলা যাবে না।” রাজনৈতিক শিবির মনে করিয়ে দিচ্ছে, এক বছর আগে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে যখন রিহানা, গ্রেটা থুনবার্গের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সরব হয়েছিলেন, তখন মোদীর পাশে দাঁড়িয়ে, রিহানাদের বিরোধিতা করেছিলেন লতা।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ মোদীর বিপরীত মেরুতে থাকা নেহরু-গান্ধী পরিবারের সদস্যেরাও একই ভাবে আবেগদীপ্ত। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধীর শোকবার্তা, “কোকিলকন্ঠী লতাজির মধুর স্বর মৌন হয়ে যাওয়ায় আমি স্তব্ধ। হৃদয়স্পর্শী স্বর, রাষ্ট্রপ্রেমের গান, লতাদিদির সংঘর্ষময় জীবন— পরবর্তী প্রজন্মগুলির জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।” তিনমূর্তি ভবনে নেহরুর চা-চক্রে ইন্দিরা গান্ধী লতার হাত ধরে তাঁর সঙ্গে দু’টি বাচ্চার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘এরা তোমার সর্বকনিষ্ঠ ভক্ত!’’ সেই দু’জন ছিলেন রাজীব এবং সঞ্জয়! আজ রাজীব গান্ধীর পরবর্তী প্রজন্ম লতা-স্মৃতিতে উদ্বেল। ইন্দিরার সঙ্গে লতার একটি সাদা-কালো ছবি পোস্ট করেছেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি লং প্লেয়িং রেকর্ড হাতে নিয়ে দু’জনে দেখছেন। প্রিয়ঙ্কা লিখেছেন, “ভারতীয় সঙ্গীতের উদ্যানকে যত্ন করে সাজিয়েছিলেন যিনি, সেই সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের চলে যাওয়ার বেদনাবহ সংবাদ পেলাম। ঈশ্বর লতাজিকে তাঁর শ্রীচরণে স্থান দিন।” রাহুল গান্ধীও টুইট করে বলেন, “বহু দশক ধরে লতা মঙ্গেশকর ভারতের সবচেয়ে প্রিয় কণ্ঠ। তাঁর সোনার কণ্ঠের মৃত্যু নেই। ভক্তদের হৃদয়ে তা বেজেই চলবে।”
প্রয়াত শিবসেনা প্রধান বালসাহেব ঠাকরের সঙ্গে আজীবন শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল লতার। বালসাহেবের মৃত্যুর পরে মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মনোহর জোশীর সম্পাদনায় ‘শিবসেনা: কাল, আজ, পরশু’ নামে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে লতা একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, মহারাষ্ট্র যখন নিজের সত্তা হারিয়ে শীতঘুমে চলে যাচ্ছল, তখন শিবসেনা প্রবল পরিশ্রম করে তাকে কোমা থেকে উদ্ধার করে। বম্বের নাম পাল্টে মুম্বই করা হয়। লতা এ পরামর্শও দিয়েছিলেন যে, শুধু মুম্বইয়ে আটকে না থেকে দিল্লির দিকেও তাকানো উচিত শিবসেনার। ঠাকরে পরিবারের সঙ্গে কার্যত পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। অসুস্থ লতার খোঁজ নিতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন উদ্ধবের স্ত্রী রশ্মি। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শেষকৃত্যের খুঁটিনাটি সামলেছেন উদ্ধব। আর রাজনৈতিক পথ আলাদা হয়ে গেলেও শিবাজি পার্কে এসেছেন রাজ ঠাকরে। শেষকৃত্যে আগাগোড়া উপস্থিত থেকেছেন তিনিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy