Advertisement
E-Paper

জৌলুসের গুজরাতে অনুজ্জ্বল শিক্ষা, স্বাস্থ্য

উন্নয়নের যে ‘গুজরাত মডেলের’ কথা বার বার বিজেপির কর্তারা প্রচার করেন, তার ছায়ায় কী রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর এই শহরে?

ঘুড়ি উৎসব আমদাবাদে।

ঘুড়ি উৎসব আমদাবাদে। —ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪৯
Share
Save

সূর্যের উত্তরমুখী যাত্রা শুরুর উৎসব সদ্য নিভেছে সবরমতী তীরবর্তী শহরে। কয়েক দিন আগেই মকর সংক্রান্তির ঘুড়ির উড়ানে আকাশমুখী ছিল এই শহর।

শাহপুর এলাকায় ঘুড়ির মাঞ্জার দীর্ঘ বিপণি দেখতে গিয়েছি। তারই ফোকরে রাস্তায় ফলমূল নিয়ে বসেছেন কিছু ছন্নছাড়া মানুষ। তাঁদের এক জন জুকাভাই তাবড়ে। কেওড়িয়া থেকে পরিবার-সহ উৎখাত হয়ে এই শহরে এসেছেন পেটের ধান্দায়। জানালেন, কেওড়িয়া গ্রামের পাশে, বিশ একর জমির উপর তৈরি হওয়া মেগা সরকারি গেস্ট হাউস, সর্দার পটেলের মূর্তির সামনে। জুকাভাই বলেন, ‘‘পাশেই সাত একরের পার্কিং লট। সেখানেই ছিল আমার ফলের দোকান, বাড়ি, জমি। যাবজ্জীবনের ভিটে কেড়ে বহু দূরে যে জমি দিয়েছে, তা চাষের অযোগ্য। তা-ও হাতে জমির দস্তাবেজ পাইনি, খাব কী? শহরে এসে এই ভাবে টেনেটুনে চালাচ্ছি।’’

উৎসব শেষে রংবাহারি আকাশ থেকে চোখ নামালে শহর ও আশপাশের জেলার শান দেওয়া হাইওয়ে, যত্রতত্র উড়ালপুল, মধ্যরাত্রি পর্যন্ত রিভারফ্রন্টের জৌলুস, কার্নিভাল আর উৎসবের আয়োজন দেখা যায়। আমদাবাদ থেকে গান্ধীনগর পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার ছুটে চলে তিন কামরার মেট্রো রেল। বাইরে থেকে আরও নজরে আসে, অজস্র বেসরকারি প্রাসাদোপম ম্যানেজমেন্ট, তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিং
মল ও বিপণি।

উন্নয়নের যে ‘গুজরাত মডেলের’ কথা বার বার বিজেপির কর্তারা প্রচার করেন, তার ছায়ায় কী রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর এই শহরে? যেখানে বিজেপি শাসনের মেয়াদ দীর্ঘ সাতাশ বছর, যার মধ্যে চোদ্দো বছর মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন নরেন্দ্র মোদী। ‘‘দুই যমজ শহরের মধ্যে ছোট্ট যাত্রাপথ। তা-ও মোদী উদ্বোধন করেছেন দু’বার করে। ছ’কামরার গাড়ি চলার কথা। কিন্তু চলছে তার অর্ধেক কামরা। ২০১৭ সালে শুরু হয়েছিল কাজ, ’২২ পর্যন্ত হয়েছিল মাত্র ৬ কিলোমিটার।

এই হল গুজরাত মডেলের গতি,’’ বলছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ হেমন্ত শাহ, যিনি দীর্ঘদিন ধরে এই রাজ্যে সামাজিক সূচকগুলি নিয়ে কাজ করছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে। বলছেন, ‘‘২০২০ সালে নতুন কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির ঘোষণা, জিডিপি-র ৬ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ করতে হবে রাজ্যগুলিকে। গুজরাতে হচ্ছে ১.৫৩ শতাংশ, যেখানে অন্য রাজ্যগুলির গড় ৪ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা পুরোপুরি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের। ১৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপাতে ৬৩টি বেসরকারি আকাশছোঁয়া ফি দিয়ে ঢুকতে পারার মতো বিশ্ববিদ্যালয়!’’

গুজরাত মডেলে স্বাস্থ্য পরিস্থিতিও যে যথেষ্ট অনুজ্জ্বল, বলছে সাম্প্রতিক সরকারি তথ্যই। ২০১৭ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে বলা হয়, রাজ্য বাজেটের অন্তত ৮ শতাংশ অথবা মোট জিডিপি-র আড়াই শতাংশ রাজ্যকে খরচ করতে হবে স্বাস্থ্যখাতে। অথচ গুজরাতে, রাজ্য বাজেটের সাড়ে ৪ শতাংশ এবং জিডিপি-র ১ শতাংশ খরচ করা হয় স্বাস্থ্যে। রাজ্যে পাঁচ বছরের নীচে ৪৩ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ১৫ থেকে ৫৯ বছরের বন্ধনীর মহিলাদের ৬৩ শতাংশ ভুগছেন ওই একই কারণে।

‘‘বলতে পারেন, গুজরাত যদি এতই সমৃদ্ধ হবে, তা হলে গুজরাত থেকে দলে দলে মানুষ বেআইনি পথে আমেরিকা, কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ় এবং ফ্রান্সে কেন পাচার হতে চাইবে? অনেক ধনী গুজরাতিও বেআইনি পথে টাকা দিয়ে এখান থেকে পালাবেন কেন? এক বিরাট চক্র গড় উঠেছে এবং নিয়মিত ধরাও পড়ছেন তাঁরা। বিষয়টি আর গোপন নেই,’’ প্রশ্ন তুলছেন সেট্রিক প্রকাশ। ‘সিটিজেন ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস কমিটি’র অন্যতম সদস্য এবং মানবাধিকার কর্মী এই প্রবীণ বিশপ। অস্বীকার করার উপায় নেই, সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন যে বেআইনি অভিবাসীর ভারতীয় তালিকা তৈরি করছে, তাতে পঞ্জাব এবং হরিয়ানার পাশাপাশি শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে মোদীর রাজ্য গুজরাত। এখানকার খ্রিস্টান সমাজের ভিতরে ক্ষোভ ও অভিযোগ, এক দিকে মোদী সরকার কিছু বিশপকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তার পর তাদের কিনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্য দিকে, সংখ্যালঘু নিপীড়ন মুসলমানদের পাশাপাশি খ্রিস্টানদের উপরেও কম চলছে না। সম্প্রতি একটি অখ্রিস্টান স্কুলে বড়দিনের উৎসব পালন করছিল শিশুরা। গেরুয়া কিছু প্রতিনিধি এসে সেখানে তাণ্ডব চালিয়েছে। প্রতিবাদে মিছিল এবং যতটা সম্ভব রাস্তায় নামছে সম্প্রদায়।

মেরুকরণ এবং হিন্দুত্বের প্রথম রসায়নাগার এই রাজ্যে ২০০২-এর পরে চোখে পড়ার মতো বড় মাপের সাম্প্রদায়িক অশান্তি আর হয়নি। কিন্তু স্থানীয় মহল বলছে, কাজ চলছে নিরন্তর, অন্তরালে। যেমন, মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর ভাষ্যকে ‘ভুলিয়ে’ বীর সাভারকরকে ‘নায়ক’ বানাতে যৌথ ভাবে তৎপর সরকার ও আরএসএস। লেখক ও মানবাধিকার আন্দোলনকারী মেহুল দেবকলার বক্তব্য, ‘‘গান্ধীর আদর্শে তৈরি হওয়া গুজরাত বিদ্যাপিঠে ঐতিহ্য, গান্ধীবাদী উপাচার্য। সম্প্রতি সেখানে পুরোপুরি দখল নিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। সাত জন গান্ধীপন্থী ট্রাস্টিকে পদত্যাগ করানো হয়েছে। আরএসএস শতবর্ষ অনুষ্ঠানের কেন্দ্র বাছা হয়েছে গান্ধীর এই বিদ্যাপীঠ।’’

প্রচারযন্ত্রের আড়ালে আরও একটি পদক্ষেপ করেছে বিজেপি সরকার, জানাচ্ছেন মেহুল। ২০২৩-এ ‘আনা দ্য গুজরাত পাবলিক ইউনিভার্সিটিজ় অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে সমস্ত সরকারি এবং স্বয়ংশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ছাত্র সংসদ কার্যত তুলে দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপকদের নিয়োগ, বদলি হচ্ছে সরাসরি রাজ্য সরকারের নির্দেশে। অর্থাৎ, শুধু বর্তমান নয়, গুজরাতের ভবিষ্যৎ মস্তিষ্কও যাতে হিন্দুত্ববাদে সংলগ্ন থাকে। (চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Gujarat

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}