অযোধ্যার নির্মিয়মান রাম মন্দির। —ফাইল চিত্র।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে অযোধ্যার রামলালার স্থান হয়েছিল তাঁবুর নীচে। ১৯৯২ থেকে শুরু করে রামমন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়দান পর্যন্ত তাঁবুর নীচেই চলত রামলালার পুজোআচ্চা। রামমন্দিরের কাজ শুরু হওয়ার আগে ২০২০ সালের মার্চে ফাইবারের তৈরি অস্থায়ী মন্দিরে রুপোর সিংহাসনে রামলালার সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়। সে বছর অগস্টে রামমন্দিরের ভূমিপুজো করতে এসে এই মন্দিরের সামনেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন। এখন সেখানেই ভক্তরা রামলালার দর্শন করতে আসছেন।
অযোধ্যার রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্টের কর্তারা বলছেন, ফাইবারের তৈরি সেই মন্দিরের আয়ু ফুরোতে চলেছে। চার বছর টিকবে এমনটা ধরে নিয়ে সেই অস্থায়ী মন্দির বানানো হয়েছিল। সেখানে বেশি দিন রামলালাকে রাখা সম্ভব নয়। তার উপরে রোজ ভিড় বাড়ছে। সেই কারণেই তাড়াহুড়ো করে আগামী ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধন করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরের উদ্বোধন করে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবেন। এখনও অবশ্য তিন তলা রামমন্দিরের প্রথম তল বাদে বাকি দুই তলের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। বিরোধীরা স্বাভাবিক ভাবেই বলছেন, লোকসভা ভোটের আগে হিন্দু ভাবাবেগকে উস্কে দিতে রামমন্দিরের তাস খেলতে চাইছেন মোদী। সেই কারণেই তাড়াহুড়ো করে অসম্পূর্ণ মন্দির খুলে দেওয়া হচ্ছে।
এই রাজনীতি থেকে দূরে থাকার চেষ্টাতেই রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্টের কর্তারা বলছেন, রামমন্দির উদ্বোধনের সঙ্গে রাজনীতি বা নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। রামমন্দিরের প্রোজেক্ট ম্যানেজার জগদীশ শঙ্কর আফলে বলেন, “চার বছরের বেশি সময় অস্থায়ী মন্দিরে রামলালাকে রাখা সম্ভব নয়। অস্থায়ী মন্দির দর্শন করতে এখনই দিনে ২৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার দর্শনার্থী ভিড় করছেন। গত এপ্রিলে রামনবমীর সময় ১ লক্ষ ৩৬ হাজার দর্শনার্থীর ভিড় হয়েছিল। ২১ ফুট উঁচু মন্দিরের সামনে ছোট্ট পরিসরে এত লোকের ভিড় সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। সেই কারণেই রামমন্দির খুলে দেওয়া হচ্ছে। কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক চাপের মুখে আগেভাগে মন্দির খুলে দেওয়া হচ্ছে না।” জগদীশ বলেন, রামমন্দির খুলে গেলে প্রতি দিন দু’লক্ষ মানুষ রামলালার দর্শন করতে পারবেন।
বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে রাম জন্মভূমি আন্দোলনে ইতি পড়েছিল। তারপরে প্রায় তিন দশক অযোধ্যা কার্যত থমকে ছিল। রামমন্দিরের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই গোটা অযোধ্যা জুড়ে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। নতুন বিমানবন্দর, অযোধ্যার নতুন স্টেশন থেকে সরযূর ঘাট থেকে হনুমানগড়ি মন্দির হয়ে রামমন্দির পর্যন্ত ভাঙাগড়ার খেলা চলছে। কিন্তু অনেক কাজই এখনও শেষ হয়নি। রামমন্দির পরিসরের ভিতরেও অনেক কাজ এখনও বাকি। উদ্বোধনের আগে রামমন্দিরের ভিতরের পরিসর ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক চম্পত রাই বলছিলেন, “ধর্মীয় ভাবাবেগ তো আছেই। অযোধ্যার রামমন্দির ইঞ্জিনিয়ারিং দিক থেকেও এক আশ্চর্য সৃষ্টি হতে চলেছে। প্রথম তলে গর্ভগৃহে রামলালার মূর্তি প্রতিষ্ঠা হবে। দ্বিতীয় তলে গর্ভগৃহে রামের রাজবেশে সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্নের সঙ্গে মূর্তি প্রতিষ্ঠা হবে। দ্বিতীয় তলের কাজ কিছুটা বাকি রয়েছে। নাগর শৈলীতে তৈরি এই মন্দিরগোটা দেশের সামগ্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রচেষ্টার ফল।”
প্রথমেই ধরা নেওয়া হয়েছিল, রামমন্দিরের আয়ু অন্তত এক হাজার থেকে আড়াই হাজার বছর হওয়া দরকার। তার আগে এই মন্দিরের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। রামমন্দিরের ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার গিরিশ সহস্রভোজনী বলেন, “সাধারণত কংক্রিট ও লোহার মিশ্রণে যে কোনএ নির্মাণ হয়। অন্তত এক হাজার বছর মন্দির অক্ষত রাখতে হবে এই লক্ষ্য নিয়ে আমরা লোহা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, লোহার আয়ু বড়জোর দুশো বছর। তার বদলে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের নির্মাণ শৈলী অনুযায়ী শুধুমাত্র পাথর ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্টের কর্তারা বলছেন, রাজস্থানের নাগৌর থেকে মাকরানা মার্বেল পাথর আনা হয়েছে। তার উপরে কারুকার্য করার জন্য মধ্যপ্রদেশের মান্ডলা থেকে রঙিন পাথর নিয়ে আসা হয়েছে। রাজস্থানের ভরতপুর থেকে প্রায় ৪.৭ লক্ষ ঘনফুট মাপের গোলাপি রঙের বেলেপাথর নিয়ে আসা হয়েছে। তামিলনাড়ু ও তেলঙ্গানা থেকে এসেছে গ্র্যানাইট। মন্দিরের ভিত তৈরি করতে ১৭ হাজার গ্র্যানাইট পাথর ব্যবহার হয়েছে। যার এক-একটির ওজন ২৮০০ কিলোগ্রাম। সরযূ নদীর জল যাতে কোনও ভাবেই মাটির তলা দিয়ে চুঁইয়ে এসে মন্দিরের কাঠামোর ক্ষতি করতে না পারে, তার জন্য মাটির নীচে ১২ মিটার দীর্ঘ গ্র্যানাইটের দেওয়াল তৈরি করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের বলহারশাহ ও আল্লাপল্লি অভয়ারণ্যের ৪.৬ কোটি টাকা দামের সেগুন কাঠ নিয়ে আনা হয়েছে। মন্দিরের মধ্যে ৪৪টি সেগুন কাঠের দরজা তামা দিয়ে মুড়ে তার উপরে সোনার জলের প্লেটিং করানো হচ্ছে। জগদীশ বলেন, রামমন্দিরের নির্মাণ কৌশল ঠিক করার আগে গোটা দেশের সাড়ে পাঁচশো মন্দির খতিয়ে দেখা হয়েছে। মথুরা ও কাশীর অনেক মন্দির বাজ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই রামমন্দিরে ২ লক্ষ অ্যাম্পিয়ার বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। স্পেন ও জার্মানিতে তা পরীক্ষা করানো হচ্ছে। ১৬১ ফুট উঁচু রামমন্দিরে কারুকার্য করা ৩৯২টি স্তম্ভ থাকছে। তার মধ্যে ১৯০টি প্রথম তলে। মন্দির ঘিরে থাকবে ১৪ ফুট চওড়া ৭৫৬ মিটার দীর্ঘ প্রাচীর। তার উপর দিয়েই দর্শনার্থীরা মন্দির প্রদক্ষিণ করতে পারবেন।
এখন ফাইবারের তৈরি অস্থায়ী মন্দিরে প্রায় সাড়ে নয় কেজি ওজনের রূপোর সিংহাসনে ছোট্ট রামলালার মূর্তি বসানো ছিল। সেই মূর্তিও নতুন মন্দিরে ‘চলমূর্তি’ হিসেবে স্থান পাবে। ‘অচলমূর্তি’ হিসেবে নতুন রামলালার মূর্তির দৈর্ঘ্য হবে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি মাপের। রামমূর্তির কপালে প্রতি বছর রামনবমীর সময় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে পড়বে।
এখনও তিনটি মূর্তি তৈরি হচ্ছে। একটি গ্র্যানাইটের, একটি মার্বেলের, অন্যটি শিস্ট পাথরের। সাধারণত দেবতার মূর্তি মার্বেল পাথরের হলেও রামের গায়ের রং শ্যামবর্ণ ছিল বলে গ্র্যানাইটের মূর্তিও তৈরি করা হয়েছে। ২২ জানুয়ারির প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে ঠিক হবে, কোন মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হবে। যে মূর্তি দর্শনে ভাবাবেগ সবথেকে বেশি উথলে উঠবে, রামের সেই মূর্তিই বেছে নেওয়া হবে।
শেষ পর্যন্ত, ভাবাবেগটাইআসল কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy