Advertisement
২৫ অক্টোবর ২০২৪
Cyclone Dana

বিপন্নদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শুনছি হাওয়ার শব্দ

তিন বছর আগে ইয়াসের সময়েও আমাদের ধামরাতেই ‘ল্যান্ডফল’-এর কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা বালেশ্বরের কাছে বাহানাগার বরজদেউলিতে ধাক্কা মারে। তবে ঘূর্ণিঝড় বা মহাবাত্যা কাকে বলে, তা তো আমরা হাড়ে হাড়ে জানি।

ভদ্রকে ত্রাণশিবিরে ঠাঁই নিয়েছেন মহিলারা।

ভদ্রকে ত্রাণশিবিরে ঠাঁই নিয়েছেন মহিলারা। ছবি: পিটিআই।

ভরত মাঝি (ধামরার বাসিন্দা)
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:১৩
Share: Save:

প্রস্তুতি যেমনই থাক, গভীর রাতের মহাবাত্যার হামলা কোথায় বেশি ঘা মারল, তা পুরোপুরি এখনই বোঝা মুশকিল। ধামরার সাইক্লোন সেন্টারে বিপন্ন মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে রাত দেড়টায় হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ শুনছি। অভিজ্ঞতা বলছে, ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিবেগ। কোথায় কী ক্ষয়ক্ষতি হল ভেবে শিউরে উঠছি। রাতে ঘূর্ণিঝড়ের সব থেকে বড় অসুবিধা, অনেক জায়গাতেই কেউ বিপদে পড়লেন কি না, পুরোটা বোঝা যাবে না। দানার মাটি ছোঁওয়ার পর্ব চলছে মধ্য রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। কোথায় কী অবস্থা, দিনের আলোতেই দেখতে বেরোতে হবে।

তিন বছর আগে ইয়াসের সময়েও আমাদের ধামরাতেই ‘ল্যান্ডফল’-এর কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা বালেশ্বরের কাছে বাহানাগার বরজদেউলিতে ধাক্কা মারে। তবে ঘূর্ণিঝড় বা মহাবাত্যা কাকে বলে, তা তো আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। আমার বাড়ি ধামরা থেকে আধ কিলোমিটার দূরে চাড়িজা গ্রামে। হাফ কিলোমিটার দূরেই ওড়িশার গুরুত্বপূর্ণ ধামরা বন্দর। বন্দরের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে সকাল থেকে বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ারেরা ভিড় করেছেন। আমার সারা দিন বিভিন্ন সাইক্লোন সেন্টারে ঘুরে ঘুরেই কেটে গিয়েছে। সন্ধ্যায় এক জায়গায় চেঁচামেচি করে জেনারেটর ঠিক করালাম। কিন্তু মাইকের গোলমাল। মাইক ঠিক না-থাকলে বিপদের সময়ে সতর্ক কী ভাবে করা হবে। বৃহস্পতিবার রাত আটটা নাগাদ একটু রুটি খেয়ে ফের সাইক্লোন সেন্টারেই বেরিয়ে গেছি। আমি ওড়িশা মৎস্যজীবী ফোরামের ভদ্রক জেলার সভাপতি। বছর তিনেক হল, নিজে সমুদ্রে বেরোই না। এই ৫৩ বছর বয়সে নিজের ছোট দোকান নিয়ে আছি। কিন্তু এখন মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই সব থেকে বড় কাজ।

১৯৯৯-এর সুপার সাইক্লোনের সময়ে আমাদের এখানে প্রথম আশ্রয় শিবির তৈরি হয়েছিল। তখন তো আর আজকের মতো প্রস্তুতি ছিল না। সে-বার জগৎসিংহপুর, পারাদ্বীপের মানুষ, গরুছাগল একাকার হয়ে হাজারে হাজারে মারা যায়। কিন্তু মহাবাত্যার কথা উঠলে ১৯৮২-র বিভীষিকাই আমায় তাড়া করে। তখন আমি ১০-১২ বছরের। মনে আছে, সে-বার গোটা গ্রামে নোনা জল থই থই। বাড়িতেও। এক ফোঁটা খাবার জল নেই। সপ্তাহভর এমন অবস্থা ছিল। ওই সময়ে আমাদের গ্রামে বিদ্যুতের আলোও ঢোকেনি। এখন মহাবাত্যার সময় এলেই সবার আগে পানীয় জলের বন্দোবস্ত, জেনারেটর, ক’দিনের খাবার মজুত রাখার কথা জরুরি মনে হয়।

আমাদের গ্রামে এখনও অন্তত ৫০টা বাড়িই কাঁচা ঘর। ক’দিন ধরে পই পই করে লোকজনকে বলেছি, কেউ কাঁচা ঘরে থাকবেন না। জগন্নাথদেবের কৃপায় আমাদের বাড়ির এক তলা পাকা ঘর। সেখানে জনা তিরিশ লোক এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কাছাকাছি তিনটে সাইক্লোন সেন্টারে ৬০০-৭০০ লোক। আরও চারটে স্কুলবাড়িতে ১০০০ লোক আশ্রয় নিয়েছেন। এখন আমার ছেলে, মেয়েরাও সব পুজোর ছুটিতে বাড়িতেই। মা, স্ত্রী আছেন। তবে বিপদের সময়ে আমাদের এখানে গোটা গ্রামটাই পরিবার হয়ে ওঠে। গ্রামের লোকজন বেশিরভাগই বাঙালি। মেদিনীপুরের দিক থেকে এসেছেন। চাষবাস, চিংড়ি ধরাই প্রধান পেশা। একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে টের পেয়েছি সারা দিনই ঘণ্টায় ৬০-৭০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইছে।

ধামরা বন্দরেও মাঝেমধ্যেই খবর নিচ্ছি, কী অবস্থা। আদানি গোষ্ঠী বন্দরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে খুব কড়াকড়ি। ডিআরডিও-র বিজ্ঞানীদেরও পরিস্থিতি দেখতে নিয়ে আসা হয়েছে। ওঁরা সব হোটেলে রয়েছেন। এখন মাঝরাত পেরিয়েও চোখে ঘুম নেই। কোথায় কী ক্ষয়ক্ষতি হল, ভাল ভাবে না জানা পর্যন্ত শান্তি পাব না।

অনুলিখন: ঋজু বসু

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Dana Cyclone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE