আজমলের বাড়ির বাইরে খুশির মেজাজ। —নিজস্ব চিত্র।
স্মার্ট সিটির আওতায় আসা উন্নয়নের রুজ় পমেটমে সজ্জিত ডাল লেকের পিছনে রয়েছে আর একটা ডাল লেক! পর্যটকরা এখানে আসেন না, কারণ এটি তো প্রখ্যাত লেকের পশ্চাদবাহী মনমরা সরু নালা বই নয়! এখানে রাতে বিশ্রাম নেয় শিকারাগুলি, বসবাস করেন রোগাভোগা শিকারা-চালকেরা। এলাকার পোশাকি নাম বারু মহল্লা। ব্যস্ত রাজপথ থেকে ঢুকে যাওয়া সরু গলি ধরে কয়েকশো মিটার এগোতেই চিনার, কাঠবাদাম-সহ হরেক গাছের জঙ্গল শুরু। আরও এগোতে তা এতটাই ঘন যে, এখানে দিনেও ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। লেক থেকে বয়ে আসা শ্যাওলা সবুজ জলের ধারে ঝিমোচ্ছে বাতিল শিকারা। ভূস্বর্গের মেঘ গাভীর মতো চরছে আসন্ন আশ্বিনের উজ্জ্বল নীলে।
বাতাস উজ্জ্বলতর, কারণ দশ বছর কায়মনোবাক্যে অপেক্ষার পর উপত্যকায় বিধানসভা ভোট এসেছে। শীর্ণ মুখগুলি কিছুটা হলেও আনন্দিত। কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়ার উষ্মা কিছুটা হলেও ব্যালট বাক্সে ঢেলে দেওয়া যাবে। বহু দিন পর সুযোগ এসেছে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পরখ করার।
‘‘মে মাসেও মানুষ রাস্তায় নেমেছিল ভোট দিতে। কিন্তু সে ছিল দিল্লির ভোট। এ বারের নির্বাচন আমাদের সুখ-দুঃখের ভোট। অধিকার আদায়ের ভোট। হয়তো এখনই রাজ্যের মর্যাদা মিলবে না। এলজি মাথার উপর থাকবেন মুখ্যমন্ত্রীর, যেমন দিল্লিতে রয়েছেন। কিন্তু এক পা হলেও তো এগোনো যাবে।’’ বসে আছি পুকুর পারে আজমল ডর-এর লগবগে একটেরে কাঠের বাড়ির উঠোনে। আজমল এই এলাকার প্রাচীন বাসিন্দা, আগে তাঁর একটি হাউসবোটের আংশিক মালিকানা ছিল। কোভিডের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেচে দিয়েছেন। ছেলেরা হাল ধরেছেন সংসারের, যে যে ভাবে পারেন।
বাড়ির পাশের চমৎকার সবুজে বাচ্চারা নাচছে হাতে লাল পতাকায় লাঙলচিহ্ন নিয়ে। অবশ্যই রাজনীতি বুঝে নয়, তবে বাতাসের খুশিয়াল ভাবটা বোধহয় সঞ্চারিত শিশুমনেও। অথবা নিছক আমোদ। কাশ্মীর তো হাড়ে হাড়ে জানে, শিশুকাল কেটে যাওয়ার পর আনন্দ কী ভাবে নিভে আসে এই সব মহল্লায়। আপাতত বাচ্চাদের উৎসাহ দিতে গান গাইছেন জমায়েত হওয়া মায়েরা। এঁরা কেউই দলীয় কর্মী বা সমর্থক নন, কথা বলে জানা গেল। এই ছোট ছোট মহল্লা বৈঠকগুলিতে যে দলেরই নেতা আসছেন (বিশেষ করে এনসি এবং কংগ্রেসের), মানুষ উৎসবে মাতছেন।
আজ এখানে এসেছেন এনসি-র নেতা ও মুখপাত্র তনভির সাদিক। বড় সমাবেশ নয়, বরং ছোট ঘরে বসে এলাকার লোকেদের সঙ্গে মজলিশই দেখছি এ বারের প্রচারের ধরন। জুতো খুলে বাইরের বারান্দায় অপেক্ষমানদের সঙ্গে বাবু হয়ে বসতেই ভোটের ভাপ টের পাওয়া গেল বেশ। এনসি-র যুব সভাপতি ইরশাদ হামিদ সুদর্শন। কথা বলতে গিয়ে উত্তেজনায় লাল ছোপ ধরল ফর্সা মুখশ্রীতে। ‘‘আপনারা কী বুঝবেন দিল্লিতে বসে, ৩৭০ তুলে দেওয়ায় কী হাল হচ্ছে! আমাদের পরিচয় চিহ্ন কেড়ে নিয়েছে কেন্দ্র। এ বারের ভোট সেই চিহ্নকে ফেরত পাওয়ার ভোট। আমাদের ইস্তেহারেও সে কথা বলা রয়েছে।’’
বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার নিয়ে অভিযোগ এক নয়, বহু। অন্তত কাশ্মীরের ভোট আবর্তিত হচ্ছে এই ৩৭০ সংখ্যাটিকে ঘিরে, তা বারবার বলছেন স্থানীয়জন। ইরশাদ বলে চলেছেন, ‘‘রাস্তার বাতির টেন্ডারও বাইরের সংস্থার। সিমেন্ট, বালি আসছে অন্য রাজ্য (বিজেপি শাসিত) থেকে। নতুন রাস্তা হচ্ছে স্মার্ট সিটির অধীনে, তার পাথর আসছে বাইরে থেকে। অথচ এর হকদার কি কাশ্মীরিরা নয়? এখানের পাহাড়ে পাথর নেই? আমাদের অর্থনীতিই গুজরাতের মতো রাজ্যের হাতে চলে যাচ্ছে। আমলাদের দিয়ে ডাল লেক পর্যটনের গুড় খাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। এই বারু মহল্লা সংলগ্ন বস্তির হাল দেখেছেন? যাঁরা পর্যটনের প্রাণ, সেই সব শিকারা-চালকেরা কোনও মতে মাথা গুঁজে রয়েছেন। স্থানীয় ছেলেপুলেদের জন্য কোনও স্কুল-হাসপাতালেরব্যবস্থা নেই।’’
লাল চকে এলে উজ্জ্বল ত্বকের শ্রীনগরকে দেখে অবশ্য ভিতরের অসুখ টের পাওয়ার জো নেই। বিভিন্ন বহুজাতিক ব্র্যান্ডের গ্লোসাইন বিজ্ঞাপনে স্বপ্নসুন্দর পুরুষ ও নারীরা। ক্লক টাওয়ারে তিরঙ্গা আলো। পর্যটকরা সুদূরের পাহাড়কে ফ্রেমে রেখে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। উনিশের লোকসভা ভোটের আগে এসে যে হাউসবোটগুলিকে নিথর ও ভুতুড়ে দেখেছিলাম, আজ তার রেলিংয়ে দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গের ভেজা জামাকাপড় শুকোচ্ছে। কথায় কথায় পৌঁছনো গেল চিনার গাছ ঘেরা ডাল লেকের গভীরে। আশপাশ থেকে ছোট নৌকা আখরোট, কেশর, রঙিন পাথরখচিত পসরা সাজিয়ে ভাসছে। বাদামের গুঁড়ো, এলাচ আর কেশর দিয়ে বানানো কাওয়া চা-এর কেটলি-বাহিত নৌকা, ভাসমান কাঠ-কয়লার উনুনে কাবাবের সম্ভার। এ রকমই এক নৌকা-ব্যবসায়ী আশফর ভাট। ‘‘৩৭০ তোলার সময় সেনা দিয়ে আমাদের জীবন অস্থির করে দিয়েছিল। সর্বক্ষণ পাহারা, ঘর থেকে বেরিয়ে কাম-ধান্দা করতে পারিনি। আর আজ বাজারে এমনই আগুন যে পর্যটক এলেও আমাদের হাল শুধরোচ্ছে না।’’
সূর্যাস্তের সম্মোহনে বুঁদ ডাল লেককে পাশে রেখে দ্রুতবেগে এখন দৌড়চ্ছে তনভির সাদিকের প্রচার গাড়ি। শালিমার গার্ডেনের উল্টো দিকের একটি মহল্লায় তাঁর দিনান্তের জনসংযোগ। গাড়িতে বসে বলছেন, ‘‘আমরা জিতে এলে প্রথম কাজ হবে বেআইনি ভাবে যে সব রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে ঢুকিয়ে রাখাহয়েছে, তাদের মুক্তির চেষ্টা শুরু করা। দ্বিতীয় কাজ, রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাওয়ার আইনি লড়াই। ৩৭০-কে ফেরানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া।’’ তাঁর যুক্তি, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত কোনও সরকার না থাকলে এলাকায় স্বাভাবিকতা আসে না। জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নির্বাচিত সরকারি প্রশাসন। কিন্তু এখানে রাজনৈতিক শূন্যাবস্থা চলছে গতপাঁচ-সাত বছর।
কিন্তু কাশ্মীরে পর্যটনের উন্নতি যে ঘটেছে, তা কী ভাবে অস্বীকার করবে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি? প্রসঙ্গটি উড়িয়ে দিচ্ছে এনসি শিবির। তাদের যুক্তি, এলজি-শাসিত প্রশাসন তীর্থযাত্রীদেরও (অমরনাথ, বৈষ্ণোদেবী) পর্যটকের মধ্যে গণনা করে ১ কোটি ৪০ লাখের হিসাব দেখাচ্ছে। এটা ফাঁপানো সংখ্যা।
ওমর আবদুল্লার দলকে শেষ প্রশ্ন ছিল, কংগ্রেস-প্যান্থার পার্টি-সিপিআইএম-এর সঙ্গে জোট বেঁধে যদি এনসি এ বার সরকার গড়েও (যার সম্ভাবনা অধিক), মুখ্যমন্ত্রী কতটা স্বাধীনতা পাবেন? মাথার উপর ছড়ি ঘোরাবে তো এলজি-র বকলমে সেই মোদী সরকারই! এনসি নেতৃত্বের বক্তব্য, নির্বাচিত সরকারের সব কাজে এলজি প্রতিনিয়ত নাক গলাতে পারবেন না। বিশেষ করে, যখন কেন্দ্রে মোদী সরকার আর আগের জায়গায় নেই। দুর্বল বিজেপির উপর লাগাতার চাপ তৈরি করে যাওয়াটাই তাই লক্ষ্য থাকবে ইন্ডিয়া মঞ্চের।
এক কথায়, আগামী ১৮ তারিখ থেকে শুরু হওয়া ভোটে কাশ্মীরিয়ৎ-এর লড়াইটা শেষ হচ্ছে না। শুরুহচ্ছে মাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy