হাতে যথারীতি অর্থমন্ত্রীর বাদামি স্যুটকেস। কিন্তু গায়ে আইনজীবীর কালো গাউন।
১ ফেব্রুয়ারির সকালে সংসদে বাজেট পেশ করতে এ ভাবেই হাজির হওয়া উচিত অরুণ জেটলির!
কারণ? তাঁর ভূমিকাটা এ বার প্রধানত উকিলেরই। নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের ফলে দেশের কী লাভ হল, সে ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী হিসেবে বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না। বিরাট কিছু ক্ষতি হয়ে যায়নি— এত দিন এই যুক্তিই দিয়েছেন তিনি। কিন্তু পুরনো ৫০০, ১০০০-এর নোট বাতিল করে, নতুন ৫০০ ও ২০০০-এর নোট চালু করে লাভের খাতায় কিছুই চোখে পড়েনি। অথচ সিদ্ধান্তটা যখন প্রধানমন্ত্রীর, তখন তার পক্ষে সওয়াল না করেই বা উপায় কী! ১২ বছর আগে আইনের পেশা ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মন দিয়েছিলেন। নোট বাতিলের এমন কঠিন মামলা মোদী তাঁর হাতে ধরিয়েছেন যে, পুরনো পেশার অভিজ্ঞতাই একমাত্র সম্বল।
নোট বাতিলের ফলে গত তিন মাসে বাজারে নগদের জোগান কমে গিয়ে বিক্রিবাটা মার খাওয়ায় স্তিমিত হয়েছে অর্থনীতির গতি। বিশ্বের সর্বোচ্চ আর্থিক বৃদ্ধির হারের মুকুট নিয়ে বড়াই করছিলেন মোদী। সেই শিরোপাও যায়-যায় অবস্থা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের মতো মোদী সরকার কিছু দিন আগে চলতি বছরের আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৭.৬ শতাংশ থেকে ৭.১ শতাংশ করে ফেলেছিল। তা-ও নোট বাতিলের ধাক্কা হিসেবে না ধরেই। মঙ্গলবার তাদের পেশ করা আর্থিক সমীক্ষার আশঙ্কা, নোট বাতিলের জেরে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। ফলে বাজেটে আর্থিক বৃদ্ধির ইঞ্জিনে ফের জ্বালানি জোগানোটা অর্থমন্ত্রী হিসেবে জেটলির প্রধান দায়িত্ব।
বাজেটে তাই এক দিকে অরুণ জেটলি আইনজীবী হয়ে নোট বাতিলের পক্ষে সওয়াল করবেন। আবার অর্থমন্ত্রী হিসেবে সেই নোট বাতিলের কালো ছায়া কাটানোর চেষ্টা করতে হবে তাঁকে।
প্রথমটির মতো দ্বিতীয় কাজটিও কঠিন। দাবি উঠেছে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সড়ক, বন্দর, রেলের মতো পরিকাঠামোয় প্রচুর টাকা ঢালা হোক। কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত আয়ে কর ছাড় দেওয়া হোক। এমনকী সবার হাতে সরাসরি টাকা তুলে দিয়ে ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থা করার দাবিও রয়েছে। যাতে খরচ করার জন্য হাতে বেশি টাকা থাকে। তাতে ঘাটতি বাড়লে বাড়ুক। উত্তরপ্রদেশের ভোটের জন্যও আমজনতার মন জয়ে দরাজ হওয়ার চাপ রয়েছে জেটলির উপর।
এতে ঝুঁকি হল, ঘাটতি বাড়ালে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর্স, মুডি’জ, ফিচ-এর মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলি ভারতের মার্কশিটে ঢ্যাঁড়া বসিয়ে দিতে পারে। এমনিতেই বিদেশি লগ্নিকারীরা এ দেশ থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। নভেম্বর থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের শেয়ার বাজার ও ঋণপত্র থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি লগ্নি বিদায় নিয়েছে। আমেরিকার ফেডেরাল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ালে আরও লগ্নি বিদায় নেবে। তখন ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়ে যাবে। তেল আমদানির খরচ বাড়বে। বাড়বে মূল্যবৃদ্ধির হার। তখন আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষে সুদের হার কমানো কঠিন হবে। এমনিতেই দেশের শিল্পপতিরা লগ্নি করতে এগিয়ে আসছেন না। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমছে। যদি শিল্পের জন্য ঋণের উপর সুদের বোঝা না কমে, তাঁরা আরও পিছিয়ে যাবেন।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রীর সামনে চ্যালেঞ্জ, নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করা। নোট বাতিলের জেরে এমনিতেই কারখানা, নির্মাণ শিল্পে শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন। চোট লেগেছে ছোট-মাঝারি শিল্পে। গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের ফের ঘরে ফিরতে হয়েছে। বেড়েছে একশো দিনের কাজের চাহিদা। সনিয়া-মনমোহন জমানার যে সব প্রকল্পকে এত দিন ‘খয়রাতি’ বলে কটাক্ষ করে এসেছেন বিজেপি নেতারা, ফের তাতেই বরাদ্দ বাড়াতে হবে জেটলিকে।
ভারসাম্য রেখে চলাটাই মুশকিল। কর ছাড় দিতে গেলে রাজস্ব আয় কমে যায়। এ দিকে পরিকাঠামো বা খয়রাতিতে টাকা ঢালতে গেলে দরকার বাড়তি আয়। ঘাটতি পূরণে বেশি ধার করতে গেলে বাড়বে সুদের বোঝা। সব থেকে কঠিন হল, অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলা।
উত্তরপ্রদেশ-পঞ্জাবের ভোটের রাজনৈতিক দাবি হল, নোট বাতিলের ফলে বিজেপি-র বড় ভোটব্যাঙ্ক ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মার খেয়েছে। তাঁদের মন জিততে উত্পাদন শুল্ক, আমদানি শুল্ক কমানো হোক। ক্ষুব্ধ গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য আয়কর ছাড়, স্বাস্থ্য বিমার মতো উপহারের দাবি রয়েছে। কর্পোরেট সংস্থাগুলি চায় করের বোঝা কমুক। অন্য দিকে অর্থনীতির যুক্তি হল, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে কড়া সংস্কারের এটাই শেষ সুযোগ। কারণ আগামী বছরের বাজেট হবে ভোটমুখী।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সতর্কবার্তা, ‘‘এক দিকে অর্থমন্ত্রী কর ছাঁটবেন, অন্য দিকে তিনিই কর আদায়ের বড় লক্ষ্য স্থির করলে মুশকিল।’’ তাঁর পরামর্শ, মোদী সরকারের উচিত, আর নতুন প্রকল্প ঘোষণা না করে ঘোষিত প্রকল্পের কাজ শেষ করা। ঘাটতি লাগামছাড়া হলে অনেক বিপদ। সকলের জন্য ন্যূনতম আয় আগে দু’একটি জেলায় পরীক্ষামূলক ভাবে চালু হোক।
জেটলি জানেন, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আসল পরীক্ষা নরেন্দ্র মোদীর সামনে। ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দুর্নীতি, কালো টাকা, জাল নোট, সন্ত্রাসে মদতের মতো প্রায় সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন বলে হাঁক পেড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সব বাদ দিয়ে এখন পড়ে রয়েছে শুধু কম নগদের অর্থনীতির স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বেচতে বাজেটে কিছু টোটকা রাখতেই হবে। তার থেকেও বেশি দরকার শব্দের মায়াজাল।
অর্থমন্ত্রী জেটলির তাই বাকপটু আইনজীবী জেটলির শরণাপন্ন না হয়ে উপায় নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy