E-Paper

মর্গ নেই, বিকৃত দেহ চিনতে ভরসা শুধু নম্বর

পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট থেকে এসেছেন নুরজামাল মণ্ডল। ভাই শেখ ইয়াদ আলির খোঁজে। সেই শনিবার থেকে ঘুরছেন হাসপাতাল আর মর্গগুলিতে।

An image of the woman

ওড়িশার সোরো হাসপাতালের সামনে প্রিয়জনের খোঁজে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডলয়।

দেবমাল্য বাগচী

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৩ ০৭:৪৯
Share
Save

নম্বর কত? নম্বর? উদ্ভ্রান্ত মানুষটি হাতের কাগজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, ‘‘১৮৮!’’ কোথা থেকে নম্বর পেলেন? কে দিল? হাতের তেলোর উল্টো পিঠ দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বললেন, ‘‘নসি ট্রেড সেন্টার থেকে দিল।’’

পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট থেকে এসেছেন নুরজামাল মণ্ডল। ভাই শেখ ইয়াদ আলির খোঁজে। সেই শনিবার থেকে ঘুরছেন হাসপাতাল আর মর্গগুলিতে। অবশ্য যদি এই ফ্রিজ়ারহীন দেহ রাখার জায়গাগুলিকে আদৌ মর্গ বলা যায়! তাঁর মতো আরও অনেকেই ঘুরে ঘুরে দিনের শেষে পাচ্ছেন একটি নম্বর। হাতে পাওয়া কাগজে রয়েছে ছবি। বিকৃত, পচা-গলা দেহের ছবিই অনেক ক্ষেত্রে। দেখে বোঝার উপায় নেই, মানুষটি কেমন ছিলেন জীবিত অবস্থায়। তার সঙ্গেই সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে নম্বরটি।

কেউ নাক বেঁধেছেন মাস্কে। কেউ জড়িয়ে নিয়েছেন গামছা। কারণ, যে টেবিলে সার দিয়ে রাখা ছিল নম্বর সাঁটানো ছবিগুলি, পচা-গলা দেহের গন্ধে সেখানকার বাতাস ভারী। শনিবার সকাল থেকে এই নসি ট্রেড সেন্টারের বাতানুকূল ঘরে রাখা ছিল বেশ কয়েকটি দেহ।

মর্গে না রেখে এখানে কেন? খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল, ওড়িশার প্রান্তিক জেলা বালেশ্বরে মর্গের অস্তিত্ব বিশেষ একটা নেই। নুরজামালই বলছিলেন, ‘‘শনিবার থেকে বালেশ্বরের কোনও মর্গ বাদ দিইনি। কিন্তু ভাইকে পাচ্ছি না।’’ এর পরেই তিনি বলেন, ‘‘পাব কী ভাবে? মর্গে দেহ তো বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ফ্রিজ়ার-সহ পরিকাঠামো ছাড়াই দেহ রাখায় সব পচে-গলে যাচ্ছে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘এর দায় সম্পূর্ণ রেল ও ওড়িশা স্বাস্থ্য দফতরকে নিতে হবে।’’

এমনই অবস্থা অন্যদেরও। যে ছবি তাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছে প্রশাসন, তার থেকে নিজের পরিজনকে শনাক্ত করা খুবই কঠিন। তাঁরা সেই ছবি নিয়ে কখনও যাচ্ছেন স্থানীয় পুলিশের কাছে, কখনও ফের হাসপাতালে। না, কারও পক্ষেই বলা সম্ভব হচ্ছে না। সব শেষে নম্বরটি পকেটে নিয়ে যখন ফের পথে নামছেন তাঁরা, প্রায় সকলেরই এক প্রশ্ন, ‘‘কোথায় পাব তারে?’’

An image of the Morgue

অস্থায়ী মর্গে শনাক্তের চেষ্টা। রবিবার বালেশ্বরে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

এই খোঁজ শুধু নসি ট্রেড সেন্টারে নয়, বাহানাগা হাই স্কুলেও চলেছে এ দিন। দুর্ঘটনাস্থলের কাছে এই স্কুলের ঘরগুলিকে অস্থায়ী মর্গ বানিয়ে সেখানে প্রাথমিক ভাবে বেশ কিছু দেহ রাখা হয়েছিল। সেখানে মর্গের মতো ঠান্ডা করার কোনও ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় মানুষের কথায়, ‘‘স্কুলে এমন ব্যবস্থা থাকবেই বা কী করে!’’

স্কুলের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। পায়ের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে, তরলের স্রোত বার হয়ে আসছে ঘর থেকে। কোথা থেকে এল জল? নাকি দেহে পচন ধরার পরে তার থেকেই বার হয়েছে এই তরল?

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সন্তোষ রায়। দক্ষিণ দিনাজপুরের তপনে বটতলা এলাকায় তাঁর বাড়ি। জামাই চন্দন রায় দুর্ঘটনার পর দিন থেকেই নিখোঁজ। সন্তোষ ঘুরে মরছেন জামাইয়ের খোঁজে। বালেশ্বর, সোরো হাসপাতালে ঘুরেছেন। সন্ধান মেলেনি। তার পরে এসেছেন বাহানাগা স্কুলে। রবিবার সকাল থেকে স্কুলের দেহগুলি ‘অশনাক্ত’ দাগিয়ে, নম্বরের ট্যাগ লাগিয়ে পাঠানো শুরু হয়েছে ভুবনেশ্বরে। সন্তোষ যখন স্কুলে ঢুকেছেন, তখনও পাঁচটি দেহ রয়েছে সেখানে। কিন্তু জামাইয়ের খোঁজ করতেই পারেননি তিনি।

সন্তোষ বলছিলেন, ‘‘এখানে যে ক’টা দেহ রয়েছে তা শনাক্ত করাই কঠিন। কোনও পরিকাঠামো ছাড়াই স্কুলে দেহ রেখে পচানো হয়েছে।’’ তাঁর পাশে দাঁড়ানো আর এক ব্যক্তি বলে উঠলেন, ‘‘নম্বর ছাড়া প্রশাসন তো কিছুই দিতে পারল না।’’

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাহানাগা হাই স্কুল বা নসি ট্রেড সেন্টারে দেহ সংরক্ষণ সম্ভবই নয়। তাঁরা জানাচ্ছেন, হাসপাতালের মর্গে তাপমাত্রা থাকে শূন্যের থেকে অন্তত ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে। জানা গিয়েছে, বালেশ্বর, সোরো বা নিকটবর্তী গোপালপুরের হাসপাতালের মর্গেও দেহ সংরক্ষণের কোনও ফ্রিজ়ার নেই।

বালেশ্বরের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জয়দেব মহাপাত্র মেনে নিলেন, ফ্রিজ়ার-সহ মর্গ এই জেলার কোথাও নেই। তাঁর দাবি, ‘‘আমরা প্রাথমিক পরিস্থিতিতে এই সব হাসপাতালে দেহ রেখেছিলাম। বাহানাগা হাই স্কুলেও সেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে দু’ঘণ্টা পর থেকে দেহ সরানো শুরু হয়।’’ অথচ বাস্তবে দাবি উঠেছে, দেহ সরানোর কাজ দুর্ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর থেকে শুরু হয়েছে।

এর ফলে দেহগুলিতে পচন ধরেছে। ফলে তা শনাক্ত করার কাজ হয়েছে কঠিনতর। বাতাস ভারী হয়েছে কটূ গন্ধে। স্বাস্থ্য আধিকারিকের অবশ্য দাবি, বেশিরভাগ দেহই এর মধ্যে ভুবনেশ্বর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও সেই দেহ পাঠানো নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এ দিন সকাল থেকে সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, গাড়িতে ছুড়ে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে দেহগুলি। এই ভিডিয়োর সত্যতা আনন্দবাজার যাচাই করেনি। তবে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে সব মহলে। এই ভিডিয়ো মনে করিয়ে দিয়েছে সম্প্রতি উত্তর দিনাজপুরে নির্যাতিতার দেহ ‘অমানবিক’ ভাবে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কোভিডের সময়কার কথাও তুলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু এই ভাবে ট্রাকে দেহ কেন ছুড়ে দেওয়া হবে, তার সদুত্তর দিতে পারেনি বালেশ্বর জেলা প্রশাসন। জয়দেব মহাপাত্র জানিয়েছেন, তাঁর এমন কিছু জানা নেই।

দিনভর সব খুঁজে শ্রান্ত নুরজামাল। দিনের শেষে তিনি পেলেন ওই নম্বরটি। বললেন, ‘‘বারবার ভাইয়ের মোবাইলে রিং করার পরে একজন পুলিশকর্মী ধরে জানালেন, নসি-তে ভাইয়ের মোবাইল রয়েছে। এখানে এসে শুনলাম, ১৮৮ নম্বর মৃতের পকেট থেকে এই মোবাইল মিলেছে। অথচ সেই ১৮৮ নম্বর দেহ এখানে নেই। চলে গিয়েছে ভুবনেশ্বর।’’ তার পরেই নুরজামালের সংশয়, ‘‘সেখানে গিয়েও ভাইয়ের এ ভাবে পচে যাওয়া দেহ শানাক্ত করতে পারব তো?’’

দিন শেষে তাঁর মতোই অনেকের সম্বল ওই একটি কাগজ, একটি নম্বর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Coromandel Express accident Death Morgue

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।