সেই ভিডিওর একটি দৃশ্য।
বরফ ঢাকা পাহাড়ের সামনে সামান্য শীতপোশাকে শিবের মতো ধ্যানে বসে নরেন্দ্র মোদী। পিছনে হিমালয় না আল্পস, বোঝার উপায় নেই। তাঁকে সেখানে দেখতে পেয়ে স্কুলের পোশাক পরা এক দল বাচ্চা ‘মোদী কাকা মোদী কাকা’ বলে প্রবল চিৎকার জুড়ে দিল!
মৃত্যুর ৬৭ বছর পর ধরাধামে শুধু নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। দু’জনের ছায়া মুখোমুখি। মোদীর ছায়াটি প্রণাম করল। জাতির জনকের ছায়া দু’হাত তুলে আশীর্বাদও করল প্রধানমন্ত্রীর অবয়বটিকে।
মোদীর জমানায় ঝাঁ-চকচকে শহর গড়ে উঠেছে, যার সঙ্গে হুবহু মিল মস্কোর বিজনেস সেন্টারের। একটি ইট-পাথরেরও কোনও ফারাক নেই। কিংবা তাক লাগানো উড়ালপুল। গুগল-এ ভর করে অবশ্য দেখা যাবে, সেটি আদতে দুবাইয়ের একটি এক্সপ্রেসওয়ে।
মোদীর দিল্লি দখলের ১৮ মাস পর রাতারাতি এত ‘পরিবর্তন’ ১২৫ কোটি ভারতবাসীর চোখে না পড়ুক, এক জনের চোখে পড়েছে। তিনি সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান পহলাজ নিহালনি। আপাদমস্তক মোদী-ভক্ত এই প্রযোজকই লোকসভা ভোটের সময় ‘হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী’ স্লোগানকে জনপ্রিয় করেন। আর বিজেপি জমানায় সেন্সর বোর্ডের দায়িত্ব পেয়ে মোদী-তর্পণে একটি ৬ মিনিটের ভিডিও বানিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন সিনেমা হলে-মাল্টিপ্লেক্সে ছবির ফাঁকে দেখানো হচ্ছে সেটি। লক্ষ্য, ১৮ মাসে মোদীর সাফল্য তুলে ধরা।
আদপে এটি একটি মিউজিক ভিডিও। কিন্তু তাতে স্বপ্নের গরুকে এমন গাছে তুলে দিয়েছেন নিহালনি, যা নিয়ে এখন ক্ষুব্ধ খোদ মোদীই। অবিলম্বে এই ভিডিও প্রদর্শন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যা দেখে অনেকে বলছেন, এ বার সেন্সর প্রধানের ছবিতেই কাঁচি চলল। আর সেটা চালালেন প্রধানমন্ত্রী নিজে! তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী রাজ্যবর্ধন রাঠৌরকে মোদী নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। জেমস বন্ডের নতুন ছবিতে চুম্বনের দৃশ্যে কাঁচি চালিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই বিতর্কের শিরোনামে রয়েছেন নিহালনি। জাতীয় পুরস্কারজয়ী পরিচালক গোবিন্দ নিহালনির ভাই পহলাজ নিজে অবশ্য এত দিনে ‘শোলা অওর শবনম’, ‘আগ হি আগ’ গোছের যে সব ছবি প্রযোজনা করেছেন, তাতে সেই অর্থে ‘বাজারচলতি’ উপাদান কম ছিল না। কিন্তু এখন তিনি দাবি করেন, বয়সের সঙ্গে ‘সংস্কারি’ হয়ে পড়েছেন।
তাই হয়তো খাঁড়া নেমেছে ০০৭-এর প্রণয়দৃশ্যে। যদিও পহলাজ নিহালনি তাঁর নিজের কল্পনাশক্তির জোরে বন্ড-কাহিনিকেও টেক্কা দিয়েছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, মোদী-ভজনার ভিডিও বন্ধের নির্দেশের পিছনে এটাও একটা কারণ। ভোটের আগে বা পরে মোদী যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার একটা বড় অংশই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। নিহালনির ভিডিওতে ভবিষ্যতের সেই সব অঙ্গীকার তুলে ধরা যেত। কিন্তু তা না হয়ে এখান-ওখান থেকে খামচে তোলা ভিডিও আর কল্পনার মিশেলে গোটা ব্যাপারটাই অত্যন্ত হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, বিদেশের অতি চেনা ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাটকে ‘মোদীর ভারত’ বলে চালানোর চেষ্টাটা।
আরও আছে। ভারতীয় বায়ুসেনার শক্তি হিসেবে অনায়াসে এ দেশের কোনও বিমানকে দেখানো যেত। দেখানো হয়েছে আমেরিকার একটি এফ-১৪ টমক্যাট বিমানকে। মহাকাশে সাফল্যের ঢাক পেটাতে গিয়ে জাপানের এইচটিভি-৩, নাসার একাধিক স্পেস শাটল এমনকী আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রও দেখানো হয়েছে, অথচ এ দেশের ‘চন্দ্রযান’ বা ‘মঙ্গলযান’-এর নামগন্ধই নেই। হঠাৎ করে ‘ত্যুর দ্য ফ্রাঁস’ সাইকেল দৌড়ের ক্লিপিং কেন, তার কোনও বোধগম্য কারণ নেই। তার পর পর্দায় দেখা যাচ্ছে, বিমানবন্দরে বারাক ওবামাকে স্বাগত জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি। সেই ছবির সামনে নেচে চলেছেন স্যান্ডো গেঞ্জি পরা এক যুবক।
এমনই নানা দৃশ্যে ভরা পহলাজ নিহালনির মোদী-ভজনা। ভোটের আগে ঢাক পিটিয়ে বলতেন, মোদী তাঁর ‘অ্যাকশন হিরো’। এখন তাঁর কীর্তি দেখে বিজেপি নেতারাই ঘরোয়া মহলে বলছেন, সেন্সর প্রধানের পদ পেয়ে বদান্যতায় এতটাই নুব্জ হয়েছেন পহলাজ, যে মাত্রাজ্ঞান হারিয়েছেন। সমালোচনার ঝড় তবুও সহ্য করা যায়। কিন্তু হাসির খোরাক হওয়াটা কোনও কাজের কথা কি?
এক কংগ্রেস নেতা মোক্ষম খোঁচা দিলেন, ‘‘হয়েছে ভাল! সেন্সর বোর্ডের মাথায় পহলাজ নিহালনি। আর এফটিআইআই-এর চেয়ারম্যান গজেন্দ্র চৌহান। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ! বিজেপি-ঘনিষ্ঠতা বাদ দিলে ভারতীয় সিনেমায় এঁদের অবদান কতটা, আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy