—প্রতীকী ছবি।
জল্পনা ছিল লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ‘ইন্ডিয়া’র আনা অনাস্থা বিতর্কের সূচনা করবেন তিনি। কংগ্রেসের তরফে প্রাথমিক ভাবে স্পিকার ওম বিড়লাকে সে কথা জানানোও হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীকে মঙ্গলবার সেই ভূমিকায় দেখা গেল না। তাঁর পরিবর্তে লোকসভার রীতি মেনে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস জমা দেওয়া অসমের কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ ছিলেন বিতর্কের প্রথম বক্তা। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে শুরু হওয়া বিতর্ক চলেছে ছ’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে।
বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীর দাবি, লোকসভায় কংগ্রেসের সহকারী-নেতা গৌরব অনাস্থা বিতর্কের প্রথম বক্তা হিসাবে রাহুলের নাম জমা দিয়েছিলেন স্পিকারের কাছে। কিন্তু বিতর্ক শুরুর মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ১১টা ৫৫ মিনিটে সেই নোটিস প্রত্যাহার করে নেন গৌরব। প্রসঙ্গত, গত ২৩ মার্চ ‘মোদী’ পদবি অবমাননা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে দু’বছর জেলের সাজা পাওয়ায় সাংসদপদ খারিজ হয়ে গিয়েছিল রাহুলের। শুক্রবারই সুপ্রিম কোর্টের তরফে সেই শাস্তির নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সেই স্থগিতাদেশের ৪৮ ঘণ্টা পরেই রাহুলকে তাঁর সাংসদ পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন লোকসভার স্পিকার।
মণিপুরে গত তিন মাস ধরে চলা হিংসার আবহে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে গত ২৬ জুলাই অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস জমা দিয়েছিল ‘ইন্ডিয়া’। সেই সঙ্গে তেলঙ্গানার শাসকদল বিআরএসের হয়ে পৃথক ভাবে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস জমা দিয়েছিলেন লোকসভার সাংসদ নামা নাগেশ্বর রাও। মণিপুর হিংসার পাশাপাশি মঙ্গলবার অনাস্থা বিতর্কে এসেছে দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রতিশোধস্পৃহা এমনকি, ব্যক্তি আক্রমণের প্রসঙ্গও। বিজেপির বিতর্কিত সাংসদ নিশিকান্ত দুবে কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধীকে নিশানা করায় বিরোধী সাংসদেরা একযোগে প্রতিবাদে শামিল হন। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় বিতর্ক।
ইতিহাস বলছে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই নিয়ে ২৮তম অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে চলেছে। অতীতে দেশের তিন প্রধানমন্ত্রী, মোরারজি দেশাই, ভিপি সিংহ এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী বিরোধীদের আনা এমন অনাস্থা প্রস্তাবেই গদি হারিয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম অনাস্থা প্রস্তাবটি এনেছিলেন জেবি কৃপালণী। বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব আনলেও মোদী সরকারের পতনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। কারণ, ৫৪৩ সাংসদের লোকসভায় সরকারের পতন ঘটানোর জন্য প্রয়োজন ২৭২ সাংসদের সমর্থন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সাংসদ সংখ্যা ৩৩২।
এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের পর মোদীই দু’টি অনাস্থা জয়ের নজির তৈরি করবেন। ঘটনাচক্রে, শেষ পর্যন্ত আবার বাদল অধিবেশনেই লোকসভায় অনাস্থা বিতর্কে অংশ নিতে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে। ঠিক পাঁচ বছরের ব্যবধানে। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সংসদের বাদল অধিবেশনেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। সেই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছিল কংগ্রেস-সহ কয়েকটি বিজেপি-বিরোধী দল। বিজেপির সংখ্যাধিক্যের জোরে বিরোধীদের আনা প্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছিল।
শেষ বলে ছক্কার দাবি মোদীর
বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে দলের সাংসদদের বিব্রত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অনাস্থা বিতর্ক শুরুর আগে মঙ্গলবার সকালে বিজেপির সংসদীয় দলের বৈঠকে মোদী বলেন, ‘‘শেষ বলে আমরা ছক্কা মারব।’’ এ ক্ষেত্রে ‘শেষ বল’ বলতে আগামী বৃহস্পতিবার তাঁর জবাবি বক্তৃতাকে বোঝাতে চেয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত।
মোদীকে তিন প্রশ্ন গৌরবের
অনাস্থা-আলোচনার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করলেন কংগ্রেসের গৌরব গগৈ। তিনি বলেন, ‘‘মণিপুরে গিয়েছেন রাহুল গান্ধী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ অন্যেরাও। কেন যাননি প্রধানমন্ত্রী? মণিপুর নিয়ে ৩০ সেকেন্ডের জন্য মুখ খুলতে কেন ৮০ দিন সময় নিলেন প্রধানমন্ত্রী? মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহকে কেন সরানো হল না এখনও? উনি (প্রধানমন্ত্রী) তো অতীতে গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীদের সরিয়েছেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মণিপুর জ্বলছে মানে ভারত জ্বলছে। বিচার চাইছে মণিপুর। মণিপুরে ডবল ইঞ্জিন সরকার ব্যর্থ। মোদীজি নীরব, তার কারণ মুখ খুললে তাঁর ডবল ইঞ্জিন সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। ভুল স্বীকার করতে চাইছেন না বলেই তিনি মৌন।’’
বিজেপির প্রথম বক্তা সেই নিশিকান্ত
গা জোয়ারি করে দেওঘর বিমানবন্দরের এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলে সপুত্র ঢুকে পড়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর-ও করেছিলেন। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার সেই বিতর্কিত বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবেকে দিয়েই মঙ্গলবার মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের বিতর্কের সূচনা করাল বিজেপি। লোকসভায় রাহুলের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে কটাক্ষ করে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট কোনও রায় দেয়নি। স্থগিতাদেশ দিয়েছে। উনি (রাহুল) বলছেন ক্ষমা চাইবেন না। বলেছেন ‘আমি সাভারকর নই’। আপনি কখনওই সাভারকর হতে পারবেন না।’’
এর পরেই সনিয়া গান্ধীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন তিনি। নিশিকান্ত বলেন, ‘‘সনিয়া এক জন আদর্শ ভারতীয় নারীর মতোই নিজের ছেলে-জামাইকে আগলে রাখছেন।’’ তাঁর এই মন্তব্যের পরেই বিরোধীরা সাংসদেরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানান। যার জেরে কিছু ক্ষণ সভায় অশান্তি হয়। প্রসঙ্গত শুধু বিমানবন্দরে গুন্ডামি নয়, ২০০৯ থেকে টানা তিনটি লোকসভা ভোটে গোড্ডা থেকে নির্বাচিত নিশিকান্ত তাঁর নির্বাচনী হলফনামার সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত যে নথিগুলি পেশ করেছিলেন, তার প্রতিলিপি এবং এ সংক্রান্ত নথি টুইটারে পোস্ট করে গত মার্চ মাসে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র অভিযোগ করেছিলেন, ওই বিজেপি সাংসদের পিএইডি এবং এমবিএ ডিগ্রি জাল!
সিবিআই-ইডি নিয়ে মোদীকে নিশানা
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি এবং সিবিআই নিয়ে আবার সরব হল তৃণমূল। অনাস্থা বিতর্কে সৌগত রায় মঙ্গলবার বলেন, ‘‘বিরোধীদের টার্গেট করে ইডি, সিবিআই ব্যবহার করছে বিজেপি।’’ বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিন’ নিয়েও খোঁচা দিয়েছেন সৌগত। মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকারের সঙ্গে এনসিপি নেতা অজিত পওয়ারের হাত মেলানোর প্রসঙ্গও তোলেন তিনি। মণিপুর প্রসঙ্গে মোদীকে নিশানা করে সৌগত বলেন, ‘‘মণিপুর জ্বলছে, অথচ প্রধানমন্ত্রী বিদেশে ঘুরছেন!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘টোম্যাটোর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মসংস্থানে ব্যর্থ সরকার। সংসদে কোনও প্রশ্নের জবাব দেন না তিনি। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ তিনি।’’ এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে হট্টগোল শুরু করেন শাসকদলের সাংসদেরা।
পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্য
লোকসভায় অনাস্থা-বিতর্কে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের পর বক্তৃতা শুরু করেন ডিএমকে সাংসদ টিআর বালু। তিনি বলেন, ‘‘মণিপুরে সংঘর্ষে ১৬৩ জনের মৃত্যুর পরও নীরব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।’’ শরদ পওয়ারের কন্যা তথা বারামতীর এনসিপি সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে বলেন, ‘‘বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় আসে ‘উদ্ধত’ শব্দটি।’’ কেন্দ্রের সরকারকে কৃষক-বিরোধী বলেও মন্তব্য করেন সুপ্রিয়া। বলেন, ‘‘এই সরকার কৃষক-বিরোধী। আর সেই কারণেই এই সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা নেই।’’ অন্য দিকে, মোদী সরকারের পক্ষে বক্তৃতা করতে গিয়ে শিবসেনা (শিন্ডে) সাংসদ শ্রীকান্ত শিন্ডে হনুমান চালিশা পাঠ করেন। পাশাপাশি, ‘ইন্ডিয়া’কে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন তিনি।
অখিলেশ যাদবের স্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টির সাংসদ ডিম্পল যাদব বলেন, ‘‘বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে।’’ মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্র ব্যর্থ বলে অভিযোগ করেন তিনি। লোকসভায় বিজেডি সাংসদ পিনাকী মিশ্র জানান, তাঁর দল কংগ্রেস-বিরোধী। তাই অনাস্থা প্রস্তাবে তাঁরা সমর্থন করবেন না। শিবসেনা (উদ্ধব) সাংসদ অরবিন্দ সাওয়ান্ত অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন, ‘‘মণিপুর নিয়ে ৭০ দিন ধরে মৌন ছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ওরা মৌন না থাকলে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হত না।’’
অনাস্থা-বিতর্কে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রসঙ্গ টেনে কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারি বলেন, ‘‘৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের চার বছর পরও জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচন করা হয়নি।’’ সিপিএম সাংসদ এএম আরিফ মণিপুর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আক্রমণ করে বলেন, “এটা ভারতের ইতিহাসে নজিরবিহীন যে, বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে সুপ্রিম কোর্ট। এবং সেটা করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারকে এড়িয়েই।” এই প্রসঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, “যদি প্রধানমন্ত্রীর ন্যূনতম লজ্জা থাকত কিংবা এখনও থেকে থাকে, তবে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত।”
মণিপুরের জন্য কংগ্রেসকে দুষলেন মন্ত্রী!
মণিপুর নিয়ে পূর্বতন ইউপিএ সরকারকেই দুষলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। মঙ্গলবার লোকসভায় অনাস্থা-বিতর্কে তিনি বলেন, ‘‘মণিপুরে হিংসার জন্য দায়ী ইউপিএ জমানা।’’ রিজিজু আরও বলেন, ‘‘উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জন্য কাজ করে আস্থা অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।’’ মোদীর প্রশংসা করে রিজিজু আরও বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কারণেই টোকিয়ো অলিম্পিকে সাতটি পদক জিতেতে পেরেছে ভারত।’’
মোদীর ‘জবাবের’ দিনেই রাহুলের বক্তৃতা?
কংগ্রেস সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার বিরোধী শিবিরের শেষ বক্তা হিসাবে দেখা যাবে রাহুলকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জবাবি বক্তৃতার ঠিক আগেই অনাস্থা বিতর্কে অংশ নিতে পারেন ওয়েনাড়ের সাংসদ। তবে দলেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, অনাস্থা বিতর্কের বক্তাদের তালিকায় নাম থাকায়, সংসদীয় বিধি মেনে বুধবারেও বক্তৃতা করতে পারেন রাহুল।
কেন অনাস্থা বিতর্কের সূচনা-বক্তৃতায় রাহুলের নাম তুলে ধরেও ‘পিছু হটল’ বিরোধীরা? কংগ্রেসের একটি সূত্র জানাচ্ছে, কৌশলগত কারণেই বৃহস্পতিবার মোদীর জবাবি বক্তৃতার ঠিক আগে অনাস্থা বিতর্কে বিরোধী শিবিরের শেষ বক্তা হিসাবে রাহুলের নাম ভাবা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, বিজেপি-বিরোধী জোটের ‘মুখ’ হিসাবে তাঁকে তুলে ধরা। সে ক্ষেত্রে লোকসভা ভোটের আগে ‘মোদী বনাম রাহুল’ লড়াই নতুন মাত্রা পাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy