গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
মঙ্গলবার জি২০ শীর্ষবৈঠকে অংশ নেওয়া বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের কাছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্র প্রকাশ্যে আসার পরেই জল্পনা শুরু হয়েছে, লোকসভা ভোটের আগে দেশের নাম শুধুই ‘ভারত’ করতে চলেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। এ সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল পাশের জন্যই আগামী ১৮-২২ ডিসেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে বলেও জল্পনা দানা বেঁধেছে। আর সেই সঙ্গেই আলোচনায় চলে এসেছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নানা প্রকল্প-কর্মসূচি-স্লোগানে ব্যবহৃত ‘ইন্ডিয়া’ নামের ‘ভবিষ্যৎ’। জল্পনা চলছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের নামবদল এবং পাসপোর্ট, আধার, প্যান, ভোটার কার্ড থেকে ইন্ডিয়া নাম ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা নিয়েও। যদিও সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। সেই নীরবতা আদতে জল্পনাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে।
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু জি২০ সমাবেশে অংশ নেওয়া রাষ্ট্রনেতাদের একটি নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেই উপলক্ষে আমন্ত্রণপত্রও যাচ্ছে নিমন্ত্রিতদের কাছে। সেই আমন্ত্রণপত্র ঘিরেই তোলপাড় পড়ে গিয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে। কারণ, ভারতের রাষ্ট্রপতি কাউকে কোনও চিঠি লিখলে তাতে চিরাচরিত ভাবে লেখা থাকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ কথাটি। কিন্তু জি২০-র রাষ্ট্রনেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর চিঠিতে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’ কথাটি লেখা হয়েছে। এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, আচমকা এমন বদলের কারণ কি?
এই বিষয় নিয়েই বিজেপিকে আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ এক্স-এ (সাবেক টুইটার) মঙ্গলবার লিখেছেন, ‘‘তা হলে যেটা শুনেছিলাম, সেটাই সত্যি! আগামী ৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি ভবনে জি২০ নেতাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’, অথচ চিরাচরিত ভাবে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ লেখাই দস্তুর।’’ মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ‘নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি’, রাষ্ট্রপতি ভবনের মুঘল গার্ডেন, দিল্লির ঐতিহাসিক রাজপথ নাম বদলেছে। বদলেছে ভারতীয় নৌসেনার পতাকা, ইলাহাবাদ, গুড়গাঁও শহর কিংবা ঐতিহাসিক গোরক্ষপুর রেলস্টেশনের নামও। প্রশ্ন উঠেছে, এ বার কি তবে দেশের পালা?
ঘটনাচক্রে, গত ১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়ান্স’) আত্মপ্রকাশের পরেই ‘সক্রিয়তা’ দেখা গিয়েছিল বিজেপি শিবিরে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, নামমাহাত্ম্যের জেরে বিরোধী শিবির জাতীয়তাবাদে ভাগ বসাতে পারে বুঝেই মোদী খোঁচা দিয়েছিলেন, জঙ্গি সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’ এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ‘পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া’-র নামেও ‘ইন্ডিয়া’ রয়েছে। ভারত দখলকারী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামেও ‘ইন্ডিয়া’ রয়েছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সঙ্গে নিষিদ্ধ সংগঠন ‘সিমি’-র (স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া) তুলনা টেনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘‘বিরোধী জোটের নামের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে পাপ।’’ ইন্দিরা গান্ধীর আমলে কংগ্রেসের স্লোগান ‘ইন্দিরা ইজ় ইন্ডিয়া’-কেও কটাক্ষ করেছিলেন তিনি।
আরএসএসের নীতি মেনেই?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা, বিরোধীদের জোট নয়, দেশের নাম বদলের জন্য মোদী সরকারের ‘সম্ভাব্য উদ্যোগ’ আসলে ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ তত্ত্ব নিয়ে আরএসএসের পুরনো অবস্থানের অনুসারী। সঙ্ঘ পরিবার বরাবরই ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার প্রতীক বলে চিহ্নিত করেছে। ভারতীয় সংবিধান যা-ই বলুক না কেন, আরএসএস নেতাদের যুক্তি, ব্রিটিশদের দেওয়া ওই নাম সনাতন সংস্কৃতি এবং ‘অখণ্ড ভারত’ চেতনার পরিপন্থী। এমনকি, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৩ সালে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত অসমের শিলচরে বলেছিলেন, ‘‘ধর্ষণের ঘটনা ইন্ডিয়ায় ঘটে, ভারতে নয়।’’
বিরোধীদের একাংশ মনে করছেন, লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির এই ‘ভারত-ভক্তি’র প্রচার আরও বাড়বে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, তিন তালাক প্রথা রদ, আযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণের পরে ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ এবং ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ প্রণয়নকেই পদ্ম শিবির প্রচারের মূল অভিমুখ করতে পারে বলে তাঁদের মত। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, মিজোরামের আসন্ন বিধানসভা ভোটেই তার ইঙ্গিত মিলতে পারে।
মোদীর দেওয়া নাম বদলের জল্পনা
শুধু ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প নয়, গত ন’বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে ‘ইন্ডিয়া’ নাম সামনে রেখে একাধিক কর্মসূচি এবং স্লোগানের কথা বলেছেন মোদী। প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের নকশা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ‘ডিজাইনড ইন ইন্ডিয়া’, পরিষেবা ক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সরকারের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতির কথা বলতে গিয়ে একাধিক বার তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ স্লোগান। সংসদের আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে দেশের নাম বদলে গেলে মোদীর ব্যবহৃত ‘ইন্ডিয়া’ কোথায় যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যেই। সূত্রের খবর, ওই অধিবেশনে বিজেপি সাংসদ প্রবেশ বর্মা একটি ‘প্রাইভেট মেম্বারস বিল’ আনতে পারেন। সেখানে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব থাকবে।
ইসরো থেকে আধারে ‘কোপ’?
শেষ পর্যন্ত দেশের নাম বদলে গেলে চন্দ্রযানের সাফল্যের জন্য মোদীর দরাজ প্রশংসা পাওয়া ইসরো (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন) বা দেশের অর্থনীতির নিয়ামক সংস্থা ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’ থেকে ‘ইন্ডিয়া’ বাদ পড়বে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। একই ভাবে সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখা (ইন্ডিয়ান আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্স), রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা ‘স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড’, ‘ইন্ডিয়ান অয়েল’, ‘কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড’-এর ভবিষ্যৎ নামও প্রশ্নের মুখে। দেশের অন্যতম সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র কলকাতার সদর দফতরে তবে কি এ বার অন্য নামের ফলক চোখে পড়বে? দেশের পরমাণু শক্তি নিয়ামক সংস্থা ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন অফ ইন্ডিয়া’-র কী ভাবে ‘ভারত-করণ’ হতে পারে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
‘ইলেকশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া’র বদলে অন্য কোনও নাম বদলানো প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট পরিচালনা করবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। এরই পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি নথিতে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দ বদল হবে কি না, মঙ্গলবার দিনভর তা নিয়ে জল্পনা চলেছে। পাসপোর্ট, আধার কার্ড, সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র, প্যান কার্ড থেকে ‘ইন্ডিয়া’ নাম ছেঁটে ফেলার দীর্ঘ এবং ব্যয়সাধ্য প্রক্রিয়া চালাতে কত দিন লাগবে এবং কত টাকা খরচ হবে তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।’’
‘ইন্ডিয়া’ বাতিলে সায় ছিল না মোদীর
নিরঞ্জন ভটওয়াল নামে মহারাষ্ট্রের এক ব্যক্তি ২০১৫ সালে ‘ইন্ডিয়া’ নাম বাতিল করে কেবলমাত্র ‘ভারত’ নামটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুর এবং বিচারপতি ইউইউ ললিত সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন। ওই মামলার রায় ঘোষণা করতে শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, দেশের প্রতিটি নাগরিকের ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ দু’টি নামই ব্যবহারের অধিকার রয়েছে।
ঘটনাচক্রে, ওই রায়ের আগে ২০১৫-র নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে মোদী সরকার জানিয়েছিল, ভারতীয় সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ দু’টি নামই রয়েছে। তার পরিবর্তন ঘটনোর প্রয়োজন নেই। সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে, ‘ইন্ডিয়া, অর্থাৎ ভারত, রাজ্যগুলির সমষ্টি’। অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’, দুই নামেই সাংবিধানিক সিলমোহর রয়েছে। মোদীর জামানায় ২০১৬ সালে দুই বিচারপতির বেঞ্চ রায়ে ‘ইন্ডিয়া’ নাম বাতিলের আর্জি খারিজ করে বলেছিল, ‘‘এ ধরনের আবেদন অর্থহীন।’’
মমতার নিশানা কেন্দ্রকে
দেশের নাম বদল করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার কলকাতার ধন ধান্য প্রেক্ষাগৃহে শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজকে তো ইন্ডিয়ার নাম চেঞ্জ করে দিচ্ছে বলে আমি শুনলাম। মাননীয় রাষ্ট্রপতির নামে যে কার্ড হয়েছে, জি২০-র লাঞ্চে না ডিনারে, তাতে লেখা আছে ভারত বলে। আরে ভারত তো আমরা বলি। এতে নতুনত্ব কী আছে?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ইংরিজিতে বলি ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশন। হিন্দিতে বলে ভারত কা সংবিধান। ভারত তো আমরাও বলি, ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো। এতে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু ইন্ডিয়া নামে সারা বিশ্ব চেনে। হঠাৎ এমন কী হল?’’
এখানেই থেমে না থেকে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে চড়া সুরে আক্রমণ শানিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘আজকে দেশের নামটাও চেঞ্জ হয়ে যাবে। কবে রবি ঠাকুরের নাম চেঞ্জ হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নাম চেঞ্জ করে দেওয়া হচ্ছে। বড় বড় ঐতিহাসিক সৌধের নাম বদল করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিহাসকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy