মণিপুর নিয়ে দিনভর সরগরম রাজনীতি। ছবি: পিটিআই।
বাড়ি ফেরা অসম্ভব। বলছেন, মণিপুরের রাস্তায় বিবস্ত্র করে হাঁটানো দুই মহিলার এক জনের মা। একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর দাবি, শুধু মেয়ের লাঞ্ছনাই নয়, জাতিগত হিংসা বিধ্বস্ত রাজ্যে তিনি হারিয়েছেন ছেলে এবং স্বামীকেও। সংঘর্ষের বর্ণনা দিতে দিতে গলা ধরে আসে মণিপুরের মায়ের। চোখ মুছে আঙুল তোলেন সরকার, প্রশাসনের দিকে। অসহায় মায়ের আকুতি, প্রশাসন যদি একটু সক্রিয় হত, তাঁর সংসারটা অন্তত অটুট থাকত। কিন্তু মায়ের অভিযোগের আঙুল যে মুখ্যমন্ত্রীর দিকে, সেই এন বীরেন সিংহকে অবশ্য স্বপদেই রেখে দিতে চলেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব, এমনই খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্রেফ কৈফিয়ত তলব করেই এ যাত্রায়ও এন বীরেন সিংহ ‘বেঁচে’ যেতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন। এই আবহেই উঠল আরও গুরুতর অভিযোগ। মোদী সরকার নিয়ন্ত্রিত মহিলা কমিশন দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো এবং গণধর্ষণের অভিযোগ কি আগেই পেয়েছিল? সেই অভিযোগ কি উপেক্ষা করা হয়েছিল? প্রশ্ন উঠছে হাজারও। ঠিক যেমন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের মঞ্চকে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানকে মণিপুর-আবহে বদলে দিয়ে মোদীকে মমতার সরাসরি কটাক্ষ, ‘‘এখন বিজেপির স্লোগান বেটি জ্বালাও!’’ কলকাতার মতোই দিল্লির সংসদও শুক্রবার সারা দিন মুখর ছিল মণিপুর নিয়েই। বাদল অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে কোন ধারায় মণিপুর হিংসা নিয়ে আলোচনা হবে, তা নিয়ে জোর তরজা চলে বিরোধী এবং সরকার পক্ষের। হই হট্টগোলের জেরে মুলতুবি করে দিতে হয় অধিবেশন। অন্য দিকে, মণিপুরের সেই ঘটনায় ধৃত চার জনের ১১ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সব মিলিয়ে মণিপুরে হিংসায় লাগাম না পরানো গেলেও, তা নিয়ে তরজা চলল দেশ জুড়ে, দিনভর।
মণিপুরের মা
এনডিটিভিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মণিপুরে বিবস্ত্র করে হাঁটানো তরুণীর মা। বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি জানিয়েছেন, কী ভাবে জাতিগত হিংসার বলি হয়েছে তাঁর গোটা পরিবার। কোন পরিস্থিতিতে মেয়ের লাঞ্ছনা সয়ে, স্বামী-পুত্র হারানোর বেদনা বুকে বয়ে চলেছেন অসহায় মণিপুরের মা। সাফ জানিয়েছেন, গ্রামে ফেরার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবেন না। যে ভিটে ছিল তাঁদের সংসারের পরিচয়, এখন তার কথা ভাবলেও বুক কেঁপে ওঠে। জাতিগত হিংসা সত্যিই ভিটে পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে মণিপুরের মায়ের। তিনি বলছেন, ‘‘আমাদের গ্রামে ফেরার আর কোনও আশা নেই। ফেরার কথা আর চিন্তাও করি না... না, আমরা আর গ্রামে ফেরত যাব না। আমি নিজে আর ফিরতে চাই না।’’ একটু থেমে আবার বলেন, ‘‘আমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। চাষের জমি নষ্ট করে দিয়েছে। আমি জানি না, আমার এবং আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ কী। আমার আর কোনও আশা নেই।’’ জানা গিয়েছে, গত ৪ মে, যে দিন ওই ঘটনা ঘটেছিল, সে দিনই মহিলার স্বামী এবং ছেলেকেও খুন করে উন্মত্ত জনতা।
মণিপুর প্রশাসন সূত্রে খবর, ভিডিয়ো দেখে যে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাঁদের ১১ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
বেটি জ্বালাও!
মণিপুরের একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই গোটা দেশের নজর এখন সে দিকেই। তা রাজনীতিরও বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রশ্নবাণের মুখে পড়তে হচ্ছে মণিপুরের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের অন্যতম কেন্দ্রের মোদী সরকারকে। যে প্রশ্ন সরাসরি ধর্মতলা থেকে ছুটে গিয়েছে নয়াদিল্লির রাজনীতির অন্দরমহলে। শুক্রবার ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে মোদীকে তৃণমূল নেত্রীর প্রশ্ন, ‘‘আপনার মনটা বড় করুন! আপনি বিদেশে গিয়ে দেশের জন্য কাঁদছেন। আর আপনাদের জন্য দেশের মানুষ কাঁদছে। আপনার মনে মা-বোনেদের প্রতি এতটুকু ভালবাসা নেই?’’ তার পর মমতার ঘোষণা, ‘‘একদিন এই মহিলারাই আপনাদের ছুড়ে ফেলে দেবে!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এই সরকার হল বেটি পড়াও, বেটি জ্বালাও!’’ মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, তিনি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতাদের সঙ্গে মণিপুর যেতে চান। এ ব্যাপারে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সঙ্গেও তাঁর হয়েছে বলে জানিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমার অরবিন্দের সঙ্গে কথাও হয়েছে। আমরা ওখানে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই। বলতে চাই, সারা দেশ আপনাদের পাশে রয়েছে। সকলে রাজি থাকলে আমরা ‘ইন্ডিয়া’র মুখ্যমন্ত্রীরা মণিপুরে যাব।’’
নয়া বিতর্ক
মণিপুর নিয়ে যখন কার্যত খাবি খাচ্ছে বিজেপি, ঠিক সেই সময় প্রকাশ্যে এল আরও একটি মারাত্মক অভিযোগ। উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্যের বাসিন্দা দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো এবং গণধর্ষণের অভিযোগ অনেক আগেই জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। তা হলে কি ইচ্ছাকৃত ভাবে তা উপেক্ষা করেছিল মোদী সরকার নিয়ন্ত্রিত মহিলা কমিশন? শুক্রবার একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মহিলাদের উপর বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে গত ১২ জুন জাতীয় মহিলা কমিশনে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছিল। অভিযোগপত্রের প্রকাশিত প্রতিলিপিতে দেখা যাচ্ছে, মোট তিন জন মহিলার উপর যৌন নির্যাতন এবং তাঁদের মধ্যে দু’জনকে নগ্ন করে হাঁটানোর অভিযোগ রয়েছে। শুক্রবার মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা স্বীকার করে নিয়েছেন, মণিপুরে মহিলাদের উপর অত্যাচারের অনেকগুলি অভিযোগই তাঁদের নজরে এসেছিল। এ বিষয়ে তিনি দায় চাপিয়েছেন সে রাজ্যের বিজেপি সরকারে কাঁধে। রেখা শুক্রবার বলেন, ‘‘গত তিন মাসে আমরা তিন বার মণিপুর সরকারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছি। কিন্তু কোনও জবাব মেলেনি।’’
এফআইআর
মণিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনায় দায়ের হওয়া এফআইআরে রয়েছে বিস্ফোরক তথ্য। সংবাদ সংস্থা পিটিআই সেই এফআইআরের প্রতিলিপি হাতে পেয়েছে। যেখানে দাবি করা হয়েছে, গত ৪ মে উন্মত্ত জনতা এক ব্যক্তিকে খুনও করে। তাঁর ‘অপরাধ’ ছিল, তিনি বোনকে গণধর্ষিতা হওয়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। তার পরেই দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো হয়। শ্লীলতাহানি করা হয়। এফআইআরের প্রতিলিপিতে লেখা হয়েছে, ‘‘৯০০ থেকে ১০০০ জন মানুষ একে রাইফেল, এসএলআর, ইনসাস-সহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হুড়মুড় করে আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে।’’ তার পর রয়েছে উন্মাদ জনতার তাণ্ডবের কথাও। দাবি করা হয়েছে, শুধু বাড়িঘরে আগুন লাগানোই নয়, লুটপাট চলেছিল অবাধে। সেখানেই লেখা হয়েছে, জঙ্গল থেকে পুলিশ পাঁচ জনকে উদ্ধার করেছিল। তাঁদের পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় উন্মত্ত জনতা। ১৯ জুলাই ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োয় দেখা যাওয়া চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁদের ১১ দিনের পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তাঁদের ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পরের দিন গ্রেফতার করা হয়। যদিও এ ব্যাপারে কঙ্গপকপি জেলার সাইকুল থানায় অভিযোগপত্রটি দায়ের হয়েছিল গত ২১ জুন।
মণিপুরের আঁচ দিল্লিতে
মণিপুরের আঁচ এসে পৌঁছেছে রাজধানী দিল্লিতেও। ২৬৭ ধারায় লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সব কর্মসূচি বন্ধ রেখে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ‘ঘটনা’-সহ মণিপুরের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার দাবিতে নোটিস দিয়েছিল কংগ্রেস-সহ কয়েকটি বিরোধী দল। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি নরেন্দ্র মোদী সরকার। কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী ২৬৭ ধারার পরিবর্তে ১৭৬ ধারায় আলোচনা চেয়েছেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, ১৭৬ ধারায় কেবলমাত্র তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘স্বল্পকালীন আলোচনা’ হয় সংসদে। এতে সংসদের সাধারণ কার্যকলাপ বন্ধ রাখারও প্রয়োজন হয় না। লোকসভার স্পিকার এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ২৬৭ ধারায় আলোচনার দাবিতে সায় না দেওয়ায় বিরোধী সাংসদেরা প্রতিবাদ শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবারেও দিনের মতো মুলতুবি হয়ে যায় সংসদের দুই কক্ষের অধিবেশন।
ইস্তফা দেবেন বীরেন?
মে মাস থেকে জাতিগত হিংসায় জ্বলছে-পুড়ছে মণিপুর। বার বার উঠছে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফার দাবি। কিন্তু তিনি স্বদেই আসীন। পদ যে যেতে পারে, এমন ইঙ্গিতও মিলছে না। অথচ, শুধু কুকি, জ়ো-এর মতো খ্রিস্টান জনজাতি গোষ্ঠীগুলিই নয়, মণিপুরে গত আড়াই মাসে ধরে চলা হিংসাপর্বে মুখ্যমন্ত্রী বীরেনের ‘ভূমিকা’ নিয়ে অভিযোগ তুলেছে তাঁর স্বজাতি হিন্দু মেইতেইরাও। কুকি-সহ জনজাতি গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ, গত এক মাসের গোষ্ঠীহিংসার সময়ে বীরেনের সরকারের আচরণ পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট। বিজেপির একটি সূত্র জানাচ্ছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মণিপুর সফরের সময় বীরেনকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। প্রভাবশালী বিজেপি বিধায়ক থোংগাম বিশ্বজিৎ সিংহ, রঘুমণি সিংহ-সহ পরিষদীয় দলের অনেকেই বীরেনের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন দলের অন্দরে। এই পরিস্থিতিতে গত ৩০ জন তাঁর ইস্তফার সম্ভাবনা ঘিরে নতুন ‘নাটক’ দেখা গিয়েছিল ইম্ফলে। পদত্যাগপত্র নিয়ে রাজভবনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন বীরেন। কিন্তু পথেই সমর্থক এবং অনুগামীদের চাপে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কথা জানান তিনি। এমনকি, রাজ্যপালের কাছে যে ইস্তফাপত্রটি তিনি পেশ করতে যাচ্ছিলেন, সেটিও ছিঁড়ে ফেলা হয়।
কিন্তু এই ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসার পরও কি বীরেনকে ইস্তফা দিতে বলবে না বিজেপি? গেরুয়া শিবিরের অন্দরের খবর, বিজেপি মনে করছে, মণিপুরে ধারাবাহিক হিংসা মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য একা বীরেনকে কাঠগড়ায় তোলা যায় না বলেই বিজেপির একাংশ মনে করছে। কারণ, গত ৩ মে মণিপুরের জনজাতি ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’-এর বিক্ষোভ-মিছিল ঘিরে রাজ্যে অশান্তির সূত্রপাত হওয়ার পরেই নিরাপত্তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল কেন্দ্র। তাই সরাসরি বীরেনকে দায়ী করার যুক্তি নেই বলেই মনে করছে বিজেপি।
অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন
মণিপুরকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া মূল অভিযুক্তের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। অজ্ঞাতপরিচয় কয়েক জন প্রথমে অভিযুক্তের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। তারপর গোটা বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সূত্রের খবর, এই বিক্ষোভের পুরোভাগে ছিলেন মেইতেই সম্প্রদায়ের মহিলারা। ভিডিয়োকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত ৩২ বছরের যুবককে বুধবার থৌবাল জেলা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মহিলাদের বিবস্ত্র করে হাঁটানোর সময় তিনিই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy